মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাচনে ভোটগ্রহণের মুহূর্তেও চেয়ারম্যান প্রার্থী চাচা-ভাতিজার একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাল্টা অভিযোগে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। উভয়ের বিরুদ্ধেই আচরণবিধি লঙ্ঘন, ভোটারদের ভয়ভীতি দেখানোসহ ভোটারদের মাঝে টাকা ছড়ানোর অভিযোগ উঠেছে। আলোচনায় আছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা শাজাহান খান। তিনি ছেলের পক্ষে কৌশলী প্রচারণা করছেন এমন আলোচনাও চলছে।
নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অন্তত ২৫টি অভিযোগ করেছেন পাভেলুর রহমান শফিক খান।
মাদারীপুর সদর উপজেলা পরিষদে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৮ মে। আনারস প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন এমপি পুত্র কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য মো. আসিবুর রহমান খান। তাঁর প্রতিদ্বদ্বী চাচা পাভেলুর রহমান খান মোটরসাইকেল প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করছেন।
তিনি শাজাহান খানের আপন চাচাতো ভাই ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক।
দলের নীতি নির্ধারকদের নির্দেশ উপেক্ষা করে এমপি তার নীতিতে অটল রয়েছেন বলে জানা যাচ্ছে। জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, তিনি নিজের ছেলেকে প্রার্থী করে প্রায় একশ বছরের পারিবারিক রাজনৈতিক রক্ষা করতে গিয়ে কেন্দ্রের চাপের মুখে রয়েছেন এমপি। বর্তমান সদর উপজেলা চেয়ারম্যান এমপির ছোট ভাই ওবাইদুর রহমান খান।
তার পূর্বে পরপর দুই টার্ম চেয়ারম্যান ছিলেন পাভেলুর রহমান শফিক খান। তৃণমুলে তার যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে।
নির্বাচনের অনেক আগে ছেলের পক্ষে গোপনে প্রচার-প্রচারণার কাজ করে আসছেন শাজাহান খান। তাঁর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবার লিখিত অভিযোগ করেন চেয়ারম্যান প্রার্থী পাভেলুর রহমান। এসব অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শাজাহান খানকে সতর্ক করে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
একই সঙ্গে শাজাহান খানকে নির্বাচনী সব কর্মকান্ড থেকে দূরে থাকার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়।
নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী স্থানীয় এমপি মন্ত্রীরা নিকটাত্মীয় বা কারো পক্ষে প্রচারণায় অংশ নিতে পারবেন না। দলও সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীদের উপজেলা নির্বাচন থেকে সরে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু শাজাহান খান এমপি স্থানীয় কর্মসূচির নামে গোপনে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন। এদিকে তার ও তার ছেলের বিরুদ্ধে কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগ করেছেন পাভেলুর রহমান শফিক খান। এ অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদ সম্মেলন করেছেন আসিবুর রহমান খান। তিনি বলেছেন নির্বাচণে পরাজয় জেনে মনগড়া কথা বলছেন শফিক খান।
পাভেলুর রহমান বলেন, ‘শাজাহান খান তাঁর বাড়ির ভেতরে তিন সহস্রাধিক লোকের একত্রে বসার উপযোগী একটি প্যান্ডেল নির্মাণ করেছেন। যেখানে বিভিন্ন অঞ্চলের নেতা-কর্মী, জনপ্রতিনিধি ও ভোটারদের নিজ বাড়িতে ডেকে ছেলে আসিবুর রহমান খানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচার করে যাচ্ছেন।’
শাজাহান খান এমপি এস অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি মাদারীপুরে থাকলেও আমার ছেলের নির্বাচনী কোনো প্রচার-প্রচারণায় অংশ নিচ্ছি না। আমার বিরুদ্ধে আনীত এই সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি মাদারীপুরের নিজ বাসায় স্থানীয় নেতা-কর্মীদের নিয়ে এলাকার উন্নয়নমূলক কাজকর্ম নিয়ে আলোচনা করি, তবে এটা নির্বাচনী কোনো বিষয় না।’
গত ২৯ এপ্রিল পাভেলুর রহমান শফিক খান তার নিজ বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে শাজাহান খানের বিরুদ্ধে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন। অভিযোগ তিনি বলেন, ‘শাজাহান খান এমপি দীর্ঘদিন সংসদ সদস্য থাকায় এবং সাবেক মন্ত্রী হওয়ার কারণে অবৈধ সম্পদ ও প্রচুর বিত্তবৈভবের মালিক হয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে তিনি নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার করছেন। ইতোমধ্যে টাকার প্রভাব খাটিয়ে সন্ত্রাসী বাহিনী, কিশোর গ্যাং, ভূমিদস্যু, টেন্ডারবাজ, চাঁদাবাজদের নিয়ে নির্বাচনী ফলাফল নিজের পক্ষে নিতে চেষ্টা করছেন।’
এদিকে ৫মে পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করেন আসিবুর রহমান খান। তিনি চাচা পাভেলুর রহমান ও তাঁর কর্মী-সমর্থকদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের বিভিন্ন অভিযোগ তুলে ধরেন সাংবাদিকদের কাছে।
এক সময় শাজাহান খান এমপির সঙ্গে রাজনীতি করতেন পাভেলুর রহমান শফিক খান। ২০১৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে তাঁদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এরপরে পাভেলুর রহমান এখন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিমের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। জেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, স্থানীয় রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে বাহাউদ্দিন নাছিমের সঙ্গে শাজাহান খানের দ্ব›দ্ব রয়েছে। বাহাউদ্দিন নাছিমের অনুসারী হওয়ায় এখন জেলা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে সদর উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে পাভেলুর রহমান শফিক খানকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের একাংশ আসিবুর রহমান খানকে সমর্থন দিয়েছে। এতে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের মধ্যে দ্বদ্ব আরো বৃদ্ধি পেয়েছে।
এ বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ মোল্লা বলেন, শাজাহান খান দলীয় সিদ্ধান্ত মানছেন না। নির্বাচনী আচরণবিধিরও তোয়াক্কা করছেন না। শাজাহান খান তাঁর ক্ষমতার প্রভাব খাটিয়ে সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণে করে নিতে চান। এই দুই শক্তির দ্বন্দ্বের কারণে মাদারীপুর সদরের ১১৭ ও রাজৈর উপজেলার ৬৯টি ভোট কেন্দ্র ঝুকিপূর্ণ ঘোষণা করেছে প্রশাসন। তাই নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে।
মাদারীপুর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসার আহমেদ আলী বলেন, সদর উপজেলার সবগুলো কেন্দ্রকেই ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে এবং নির্বাচনের দিন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
মাদারীপুর সদর উপজেলা নির্বাচনে ভাইস চেয়ারম্যান পদে তিনজন এবং মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদে পাঁচজন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে সদর উপজেলা গঠিত। এখানে মোট ভোটার সংখ্যা ৩ লাখ ২২ হাজার ৪২৬ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৬৬ হাজার, নারী ভোটারের সংখ্যা ১ লাখ ৫৬ হাজার ৪২১। আর পাঁচজন আছেন তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার।
এ জাতীয় আরো খবর..