‘হোডেলের লোকগুলার ঘুমানের লইগ্যা মাচা বানাইছে। বিল্ডিংয়ের মধ্যে মাচা। ওইখানেই পুড়ছে। মাচায় পুইড়া সব শেষ...।
’ বিলাপ করে করে বলছিলেন আইয়ুব আলী। তাঁর ভাই বিল্লাল সরদার কাজ করতেন ‘বরিশাল হোটেলে’। থাকতেন রেস্টুরেন্টের ওপরের দিকে এক পাশে দোতলার নিচে বিশেষভাবে তৈরি করা মাচায়। সেখানেই ঘুমিয়ে ছিলেন আট কর্মী। তাঁদের ছয়জনের লাশ পাওয়া গেছে।
নিখোঁজ ছয়জনের স্বজনরা গতকাল বিকেলে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে গিয়ে আহাজারি করছিল। মর্গের সামনে তাদের আহাজারিতে পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। তাদের একজনের কথায় জানা যায়, বিশেষভাবে মাচা বানিয়েছিলেন বাড়ির মালিক ও রেস্টুরেন্টের মালিক। বাইরের মই দিয়ে উঠতে হয় সেখানে। আগুন লাগার পর সেখানে আটকা পড়েই মারা গেছেন ছয়জন।
চকবাজার থানার ওসি আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ভবনটিতে রেস্টুরেন্টের অংশে ওপরে ঘুমানোর জন্য মাচা করা হয়েছে। সেখানে আটজন ঘুমিয়ে থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। দুজন হয়তো উঠে বের হয়েছেন। জায়গাটি শুধু ঝুঁকিপূর্ণ নয়, দুর্গমও। পাশের অংশে ছোট মই দিয়ে সেখানে উঠতে হয়।
সংসারের চালক ছিলেন বিল্লাল
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে নিখোঁজ বিল্লাল সরদারের বোন রুমা বেগম ভাইয়ের লাশ চেয়ে বিলাপ করছিলেন। তিনি মর্গের সামনে বারবার মূর্ছা যান। রুমা কেঁদে বলেন, ‘বাড়িতে গিয়া মায়ের কাছে কী বলব? ভাইরে কোথায় পাইব? মোর ভাইটা ১০টা বছর ধইরা সংসারের ঘানি টানছিল। এখন দুইটা বাচ্চা নিয়া ওর বউ কোথায় দাঁড়াইবে?’
স্বজনরা জানিয়েছেন, বরিশালের মুলাদীর ইনচরের আলম সরদারের ছেলে বিল্লাল সরদার। তিনি বরিশাল হোটেলে খাবার পরিবেশনকারী হিসেবে কাজ করছিলেন। দৈনিক ৬০০ টাকা বেতন ও খাবারের বিনিময়ে চাকরি করছিলেন তিনি।
ওমান যাওয়া হলো না স্বপনের
নিখোঁজ স্বপন সরকারের ভাই সজল সরকার বলেন, ‘ছয় ভাই-বোনের মধ্যে ছোট স্বপন আমাদের খুব আদরের ছিল। ওমান যাওয়ার কথা ছিল। ভিসা করাইতে মেডিক্যাল হবে। ঢাকায় আসছে ১০ দিন। এসে আমার ভাই পরোটার কারিগর হিসেবে হোটেলে কাজ নেয়। এইখানেই ও হারাইয়া গেল...। ’ হবিগঞ্জের লাখাই থানার বামুই এলাকার রাকেশ সরকারের ছেলে স্বপন। তাঁর আরেক ভাই কাজল সরকার বলেন, দুই দিন পর স্বপনের মেডিক্যাল চেকআপ করানোর জন্য হবিগঞ্জে যাওয়ার কথা ছিল। ওমানের ভিসা হলে তিনি ওমানে চলে যাবেন এমন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। বাড়ি যাওয়ার জন্য ব্যাগও গুছিয়ে রেখেছিলেন স্বপন।
‘নাতিডারে আইনা মাইরা ফালাইলাম’
বরিশাল হোটেলেই খাবার পরিবেশনকারী হিসেবে কাজ করেন আবুল কাশেম। তিনি তাঁর নাতি শরিফকে খুঁজে পাচ্ছেন না। কাশেম বিলাপ করে বলেন, ‘নাতিডারে আইনা মাইরা ফালাইলাম। আমি কামে আনছিলাম...। ’ কাশেম জানান, কুমিল্লার চান্দিনার তিতচর গ্রামে তাঁদের বাড়ি। কয়েক দিন আগে তাঁর মেয়ে রহিমার ছেলে শরিফকে নিজের সঙ্গে কাজ করাতে নিয়ে আসেন তিনি। শরিফ নানার সঙ্গে থেকে কাজ শিখছিল। গতকাল নানা কাশেমও ওই ভবনে ছিলেন। আগুন লাগার কিছু সময় আগে তিনি ভবনের নিচে নেমে আসেন। শরিফের বাবা মিজান তাঁর ছেলেকে প্রথমে বাধা দেন। পরে মেয়ের সংসারে সহায়তার জন্য নাতিকে কাজে নিয়ে আসেন কাশেম।
স্বজনদের লাশ নিয়ে সান্ত্বনা পেতে চান তাঁরা
নিখোঁজ রুবেলের বড় ভাই রাসেল কেঁদে বলেন, ‘ছয়জন নেই। লাশও ছয়টা। এর মধ্যেই আমার ভাই আছে। পরিবারের সবাইরে আমি কী বুঝ দিমু? লাশটা দেন, নিয়া যাই...। ’ রাসেল জানান, মাদারীপুরের কালকিনির দক্ষিণ আকাশবরিশ গ্রামের সাত্তার হিলালুরের ছেলে রুবেল দুই সপ্তাহ আগে খাবার পরিবেশনকারী হিসেবে কাজ নেন বরিশাল হোটেলে।
নিখোঁজ ওসমানের জন্য আহাজারি করছিলেন তাঁর বড় ভাই ওয়াহেদ। তিনি বিলাপ করে জানান, দুই বছর ধরে বরিশাল হোটেলে পরোটা বানানোর কারিগর হিসেবে কাজ করছিলেন ওসমান। আগুনের খবর পেয়ে তাঁরা বিকেলে এসে ওসমানকে খুঁজতে শুরু করেন। শরীয়তপুরের গোসাইরহাট এলাকায় তাঁদের বাড়ি। ওসমানের বাবার নাম আবুল কালাম।
বরিশালের হিজলার শঙ্করপাশা গ্রামের মোস্তফার ছেলে কিশোর মোতালেব। তার ভাই মোস্তাক বলেন, ঈদের পর এসে হোটেলে খাবার সরবরাহকারীর কাজ নেয় মোতালেব।
চকবাজার থানার ওসি আব্দুল কাইয়ুম বলেন, ‘নিহতদের লাশের ও নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হচ্ছে। ছয়জনের জন্য দাবিদার ছয়টি পরিবার। বোঝাই যাচ্ছে এরাই নিহত। তবে চেহারা চেনার উপায় নেই। তাই লাশ শনাক্তে পরীক্ষা করা হচ্ছে। আর কোনো নিখোঁজ আসে কি না তা-ও দেখা হচ্ছে।
এ জাতীয় আরো খবর..