×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৮-১৩
  • ৭২ বার পঠিত
অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা, বিপুল বৈদেশিক ঋণ, রিজার্ভ ঘাটতিসহ নানা কারণে দেউলিয়া হয়েছে শ্রীলঙ্কা। করোনা মহামারির ধাক্কা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে শ্রীলঙ্কার এমন পরিস্থিতিতে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে অন্যদের কপালেও। বাংলাদেশেও এখন আলোচিত বিষয় এটি। কোন পথে এগোচ্ছে আমাদের অর্থনীতি? বাংলাদেশও কি দেউলিয়া হবে?–এমন নানা প্রশ্ন এখন মুখে মুখে। অর্থনীতির জটিল সমীকরণে এক কথায় এসব প্রশ্নের উত্তর মেলা কঠিন। তবে সংকট মোকাবিলায় সম্প্রতি বাংলাদেশের উদাহরণ টেনেছেন খোদ শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট। আর তার মন্তব্য থেকে একটি বিষয় অন্তত স্পষ্ট, নিজস্ব নানা চ্যালেঞ্জ থাকলেও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কিংবা সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের বুকে এখনও আলোকিত এক নাম বাংলাদেশ।

দারিদ্র্য ও বৈচিত্র্যহীন এক অর্থনীতি নিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী যাত্রা শুরু করেছিল বাংলাদেশ। সে সময় বাংলাদেশকে ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ আখ্যা দিয়েছিলেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জার। মার্কিন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক হলিস বি. শেনারি ১৯৭৩ সালে অবজ্ঞার সুরে বলেছিলেন, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৯০০ ডলারে পৌঁছাতেও সময় লাগবে অন্তত ১২৫ বছর। এ ছাড়াও নরওয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতিবিদ জাস্ট ফালান্ড এবং যুক্তরাজ্যের নটিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক জন রিচার্ড পারকিনসন তাদের ‘বাংলাদেশ: দ্য টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, ‘উন্নয়ন প্রত্যয়টি যদি বাংলাদেশে সফল হয়, তাহলে পৃথিবীর সব জায়গায় সফল হবে।’ তবে এসব মন্তব্য-সমালোচনা উপেক্ষা করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। আর উন্নয়নের সূচকে আজ বাংলাদেশের যে অগ্রগতি, তার ভিত্তি রচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। 

ফেরা যাক শ্রীলঙ্কা প্রসঙ্গে। দেশটির নতুন প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে সম্প্রতি বলেছেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দুর্দশা আরও এক বছর স্থায়ী হতে পারে। দেশের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার জন্য চিরাচরিত ধারার বাইরে গিয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের উদাহরণ টেনেছেন তিনি। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশকেই দৃষ্টান্ত মানছেন তিনি। 

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু এক প্রতিবেদনে জানায়, ‘লেটস রিসেট শ্রীলঙ্কা’ শীর্ষক দুদিনের এক সম্মেলনে দেশের সংকট নিয়ে এসব কথা বলেন বিক্রমাসিংহে। এ সময় শ্রীলঙ্কায় অর্থনৈতিক সংস্কারের জন্য উচ্চ কর আরোপের প্রয়োজন হবে বলেও জানান তিনি।

শ্রীলঙ্কাকে লজিস্টিক এবং পারমাণবিক শক্তির মতো নতুন খাতের দিকে নজর দিতে হবে উল্লেখ করে বিক্রমাসিংহে বলেন, ‘আমি মনে করি, আগামী ছয় মাস থেকে এক বছর অর্থাৎ আগামী বছরের জুলাই পর্যন্ত আমাদের একটি কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে।’

এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘আমি লজিস্টিকসে খুব বেশি বিশ্বাস করি। আপনি যদি ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি দেখেন; এখানে কলম্বো, হাম্বানটোটা ও ত্রিনকোমালিতে লজিস্টিকস একটি বড় ভূমিকা পালন করতে পারে।’ 

লজিস্টিক খাতে বাংলাদেশের অবস্থান 

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। এ অবস্থায় দেশে গতিশীল সরবরাহ বা লজিস্টিক খাত থাকা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সরবরাহ খাত উন্নত হলে দেশের বন্দরগুলোতে পণ্যজট কমার পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারে বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, বাড়বে রফতানি বৈচিত্র্য। একই সঙ্গে বাংলাদেশে আরও বেশি বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠবেন বিদেশি বিনিয়োগকারীরা।

উদীয়মান ৫০টি দেশের সরবরাহ খাত নিয়ে সম্প্রতি একটি সূচক তৈরি করেছে বিশ্বের শীর্ষ সরবরাহ পরিষেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান অ্যাজিলিটি লজিস্টিকস। এতে বাংলাদেশ সার্বিকভাবে ৩৯তম অবস্থানে আছে। এ তালিকার শীর্ষ পাঁচটি দেশ হচ্ছে: চীন, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া।

ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অধ্যাপক মো. মামুন হাবীব সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে জানান, বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ সরবরাহব্যবস্থার সক্ষমতায় ২০তম, আন্তর্জাতিক সরবরাহ সক্ষমতায় ৪১তম, সরবরাহ ব্যবসার মৌল ভিত্তির উপসূচকে ৪৪তম এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় ৩৪তম অবস্থানে রয়েছে।

তবে লজিস্টিক খাতের সামগ্রিক উন্নয়ন ও বিকাশে বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে বিভিন্ন ধরনের প্রণোদনামূলক কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং ২০৪১ সালের বাংলাদেশের জন্য প্রণীত প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় লজিস্টিক খাতকে একটি প্রাধিকারমূলক খাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, লজিস্টিক খাতের উন্নয়নে সরকার যে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তা স্পষ্ট। 

লজিস্টিকস খাতে বিনিয়োগের সম্ভাবনা অপরিসীম। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের পরিবহন ও অবকাঠামো খাতে প্রায় ২৮৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রয়োজন হবে। আর এই খাতগুলোর প্রদত্ত সেবার জন্য বছরে প্রায় ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাজার রয়েছে। ব্যবসার আয়তন বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই বাজারও আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে।

শুধু তাই নয়, ব্যবসা এবং অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধির পাশাপাশি পণ্যাগার, সংরক্ষণাগার, কোল্ড চেইন ব্যবসা, সড়ক, নৌ, সমুদ্র এবং বিমানপথে পণ্য পরিবহন, নৌ, বিমান ও স্থলবন্দরের কার্যক্রম আনুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাবে।

মূলত এ জায়গাটিতেই বাংলাদেশকে অনুসরণ করতে চায় শ্রীলঙ্কা। দেশটির প্রেসিডেন্ট মনে করছেন, লজিস্টিক খাতে বাংলাদেশের মতো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে পারলে দ্রুতই সংকট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে শ্রীলঙ্কা।

বাংলাদেশের সামনে যত চ্যালেঞ্জ 

বিশ্বব্যাংকের শ্রেণিকরণে ২০১৫ সালের ১ জুলাই নিম্ন থেকে নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয় বাংলাদেশ। মাথাপিছু আয় বৃদ্ধিতে ধারাবাহিক উন্নতির কারণে বাংলাদেশ এ তালিকায় আসে। ২০১৮ সালের মার্চে বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণের যোগ্য বলে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের মধ্যেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে গণ্য হবে।

তবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যুক্ত হওয়ার পর বাণিজ্যসহ বেশ কিছু সুবিধা বাতিল হয়ে যাবে বাংলাদেশের। বিশেষ করে যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো ছাড়া বাকি সব দেশে একযোগে শুল্কমুক্ত সুবিধা বন্ধ হয়ে যাবে। যদিও সেসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইতোমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ-পরবর্তী সময়ের জন্য এরই মধ্যে গঠন করা হয়েছে একটি জাতীয় কমিটি ও ছয়টি বিষয়ভিত্তিক উপকমিটি। 

আরেক বড় চ্যালেঞ্জ চলমান বিদ্যুৎসংকট। সম্প্রতি সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যুৎ সংকটের কারণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি কমে যেতে পারে। আর এ সংকট থাকতে পারে ২০২৬ সাল পর্যন্ত। বিশ্ববাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উপাদান প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ার ফলে এমন সংকট সৃষ্টি হয়েছে।

দেশের বাজারে বেড়েছে জ্বালানি তেলের দামও। শুক্রবার (৫ আগস্ট) মধ্যরাত পর্যন্ত যে পেট্রোল বিক্রি হয়েছে ৮৬ টাকায়, শনিবার (৬ আগস্ট) থেকে একই পেট্রোল কিনতে হচ্ছে ১৩০ টাকায়। একই দশা ডিজেল, কেরোসিন ও অকটেনের। ৮০ টাকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম হয়েছে ১১৪ টাকা। ৮৯ টাকায় বিক্রি হওয়া অকটেন লিটারপ্রতি বিক্রি হচ্ছে ১৩৫ টাকায়।

বাংলাদেশে আগে কখনো এক লাফে জ্বালানি তেলের দাম এতটা বাড়েনি। যদিও এমন নজিরবিহীন দাম বৃদ্ধি প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, খনিজ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় বলছে, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামের ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে সমন্বয়, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) লোকসান কমানোসহ পাচার হওয়ার আশঙ্কা থেকে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে সে অনুযায়ী জ্বালানি তেলের দাম পুনর্বিবেচনা করা হবে।

এদিকে জ্বালানি তেলের রেকর্ড দাম বাড়ায় নতুন করে আলোচনায় এসেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ প্রসঙ্গ। সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলছেন, আইএমএফের শর্ত মানতে গিয়ে বাড়ানো হয়েছে জ্বালানি তেলের দাম। তবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তা নাকচ করে দিয়ে বলেছেন, দাম বৃদ্ধির সঙ্গে আইএমএফের শর্তের কোনো সম্পর্ক নেই।

চীনের কাছ থেকে বিপুল ঋণ নিয়েই শ্রীলঙ্কা দেউলিয়া হয়েছে বলে মনে করেন অনেকে। বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বিভিন্ন সময় চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়েছে বাংলাদেশও। ফলে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, বাংলাদেশ কি তাহলে শ্রীলঙ্কার পথেই হাঁটছে?

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীনের কাছে বাংলাদেশের ঋণ মোট বৈদেশিক ঋণের ২৯ শতাংশের কিছু বেশি। গত ১০ বছরে ১২টি প্রকল্পের জন্য বেইজিংয়ের সঙ্গে ১৭ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণচুক্তি করেছে ঢাকা, যা ২০৩১ সালের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। ২০২১-২২ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের মোট বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। যদিও বাংলাদেশ কখনো ঋণ খেলাপি হয়নি, ভবিষ্যতেও সেই সম্ভাবনা কম।

সংকট মোকাবিলার উদ্যোগ 

জ্বালানিসংকট মোকাবিলায় নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে নানা নির্দেশনার পাশাপাশি সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদের সবাইকে খরচ কমানোর নির্দেশনা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গাড়ির তেল খরচ করে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের ছোটাছুটি না করে ভার্চুয়ালি যোগাযোগ বাড়ানোরও নির্দেশ দেন তিনি।

একই সঙ্গে এখনই কম গুরুত্বপূর্ণ জিনিস না কেনার নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। বলেছেন, সরকারি টাকায় বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ রাখতে।

বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং জ্বালানি তেল আমদানি কমানোরও সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে ডিজেলচালিত সব বিদ্যুৎকেন্দ্রও।

এর আগে বিদ্যুতের ঘাটতি পূরণে গত ১৯ জুলাই থেকে সারা দেশে দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিং করা শুরু করে বিদ্যুৎ বিভাগ। শপিং মল, দোকানপাট রাত ৮টার মধ্যে বন্ধেরও সিদ্ধান্ত হয়েছে। সারা দেশে সব ধরনের আলোকসজ্জা নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

সম্প্রতি আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমেও ঘুরে-ফিরে আসছে বাংলাদেশের নাম। অন্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে এসব প্রতিবেদনে যা বলা হচ্ছে, শত উদ্বেগের মধ্যেও তা অনেকটা স্বস্তির। কারণ, এখন পর্যন্ত এসব প্রতিবেদনের মূল কথা একটাই–শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতিতে পড়বে না বাংলাদেশ।

গেল ১ আগস্ট ‘যে কারণে শ্রীলঙ্কার মতো সংকটে পড়বে না বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে থাইল্যান্ডভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ব্যাংকক পোস্ট। প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনীতিতে করোনা মহামারির প্রভাব আরও বাড়িয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। এটি অস্বীকার করার উপায় নেই। এমন বৈশ্বিক সংকট বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিস্থিতি আরও কঠিন করে তুলেছে।

বাংলাদেশের নিজস্ব অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। কিন্তু দেশটির সরকার অর্থনীতির গতি ধরে রাখতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ে তুলতে, যাতে আমদানির চাহিদা সহজে মেটানো যায়। রফতানি বৃদ্ধি এবং আমদানি কমানোর নীতিও নিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। 

গবেষক ও বিশ্লেষক জন রোজারিওর লেখা ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশটির কিছু বিশ্লেষক মনে করেন শ্রীলঙ্কার মতো সংকটের দিকে এগোচ্ছে বাংলাদেশ। যে সংকট জনগণকে রাজপথে নামাবে সরকারকে উৎখাতের জন্য। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের অর্থনীতির মধ্যে যে বিশাল ফারাক রয়েছে, সেটি তুলে ধরেছে আওয়ামী লীগ সরকার।

প্রথমত, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি পর্যটননির্ভর। করোনা মহামারির কারণে এ খাতে ধস নামে। ফলে দেশটির রিজার্ভ কমতে শুরু করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আমদানি করা জ্বালানি ও ভোগ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণে রিজার্ভ আরও কমে যায়, গুরুত্বপূর্ণ সব আমদানি স্থগিত করা হয়। এতে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয় এবং সেই ক্ষোভ থেকেই পদত্যাগে বাধ্য হন গোতাবায়া রাজাপাকসে (শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট)।

এর বিপরীতে, বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল স্তম্ভ হলো গার্মেন্টস এবং রেমিট্যান্স। দক্ষিণ এশিয়ার অন্য দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অনেক শক্তিশালী। 

ব্যাংকক পোস্টের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, শ্রীলঙ্কায় জনগণের ব্যাপক ক্ষোভের আরেকটি বড় কারণ ছিল ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে পরিবারের গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের ব্যাপক দুর্নীতি। বাংলাদেশেও দুর্নীতি একটি বড় সমস্যা হলেও এখন পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে এমন কোনো অভিযোগ ওঠেনি। ফলে এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়, অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে শ্রীলঙ্কার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।

একই দিনে অর্থাৎ গেল ১ আগস্ট ‘ভূ-অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সত্ত্বেও অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রেখেছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংবাদমাধ্যম ইকোনমিক টাইমস। 

এতে বলা হয়, স্বাধীনতার দীর্ঘ ৫০ বছরে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিভিন্ন ক্ষেত্রেও দেশটি অগ্রগতি অর্জন করছে। কৃষি থেকে ফার্মাসিউটিক্যালস এবং জাহাজ নির্মাণ থেকে গার্মেন্টস পর্যন্ত বাংলাদেশের শিল্প ভিত্তি ক্রমেই বৈচিত্র্যপূর্ণ হচ্ছে এবং দেশটির রফতানি বাড়ছে। বিস্তৃত উৎপাদন খাত এবং অবকাঠামোগত উন্নয়ন; সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি এশিয়ার মধ্যে অনুসরণীয়।  

ইকোনমিক টাইমস বলছে, মহামারি-পরবর্তী অর্থনীতিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব অস্বীকার করা না গেলেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখতে বদ্ধপরিকর। তৈরি পোশাকশিল্প এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সকে বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান ভিত্তি উল্লেখ করে বলা হয়, বিশ্বের উন্নয়নশীল অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। 

ইকোনমিক টাইমসের এই প্রতিবেদনের পরপরই ২ আগস্ট বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করে নিবন্ধ প্রকাশ করে পাকিস্তানভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন। ‘টেক অ্যাওয়ে ফ্রম বাংলাদেশ’স লিডারশিপ’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধটির লেখক সাহেবজাদা রিয়াজ নূর। 

ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭১ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে বাংলাদেশে জবাবদিহির অভাব এবং সামরিক শাসনের প্রভাব থাকলেও ২০০৯ সাল থেকে সেনাবাহিনী অন্তরালে রয়েছে। বেসামরিক সরকারগুলোর ঘনঘন পা পিছলে পড়া এবং সরকারগুলোর সামান্য বৈধতা বা অবৈধতার অভিজ্ঞতা পেয়েছে বাংলাদেশ। দেশটির গণতান্ত্রিক ইতিহাস মোটেই নিষ্কলঙ্ক নয় এবং এখানকার সরকার দুর্নীতি ও অদক্ষতার বিষয়ে জনসাধারণের সমালোচনা বারবার এড়িয়ে গেছে। তবে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক দূরদর্শী এবং দৃঢ় প্রত্যয় ধারণ করেছেন। তিনি মনে করেছেন, অর্থনৈতিক অগ্রগতিই দেশের দারিদ্র্য বিমোচনের একমাত্র উপায়। 


এক্সপ্রেস ট্রিবিউন বলছে, ‘বিরোধীদের বলপূর্বক নিয়ন্ত্রণের অভিযোগ থাকলেও ১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে টেকসই প্রবৃদ্ধির মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।’ 

এক্সপ্রেস ট্রিবিউনের কলামে পাকিস্তান সরকারের সাবেক এই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা লেখেন, ‘পাকিস্তানের নেতৃত্ব বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা থেকে অনেক কিছু শিখতে পারে। তবে প্রধান পদক্ষেপটি হওয়া উচিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির প্রতি শেখ হাসিনার অগ্রাধিকারের বিষয়টি অনুসরণ করা, যা প্রতিরক্ষা এবং গণতন্ত্র উভয়ের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ।’

আশার আলো 

সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণ কিংবা অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাস যেমন বার্তাই দিক না কেন, এটি অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিশ্বের অনেক দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও কঠিন এক সময় পার করছে। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে একটি মহল যে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করে জনমনে ভীতি সঞ্চার করার চেষ্টা করছে, সেটিও সত্য। তবে বড় ধরনের সংকটে পড়ার আগে তা আমলে নিয়ে পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সরকারি নানা উদ্যোগ অবশ্যই প্রশংসনীয়। আর এসব উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়নের মাধ্যমে শ্রীলঙ্কার মতো আরও অনেক দেশের কাছে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হবে বাংলাদেশ–এমনটাই প্রত্যাশা সবার।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat