ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি এখনই কৃষিতে বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে না। তবে আগামী বোরো মৌসুম পর্যন্ত ডিজেলের বর্তমান মূল্য বহাল থাকলে তা ধানের উৎপাদন খরচ বাড়িয়ে দেবে। তাই কৃষিতে ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব ভোক্তা পর্যায়ে আসবে আগামী বছরের মার্চ নাগাদ। কারণ তখন বোরো ধানের চাল বাজারে আসবে।
ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (আইএফপিআরআই) তথ্য ধরে হিসাব করলে ডিজেলের দাম বাড়ায় শুধু সেচের জন্য বোরোতে কৃষকের খরচ বাড়বে প্রায় দুই হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। এতে প্রতি কেজি চাল উৎপাদনে বাড়তি খরচ হবে প্রায় দেড় টাকা। বোরো ধান সেচনির্ভর হওয়ায় এতে ডিজেলের ব্যবহার বেশি হয়। আমনে ডিজেলের ব্যবহার সামান্য। এখন আমনের মৌসুম চলছে।
দেশের কৃষকদের বোরো আবাদে কোন খাতে কত খরচ হয় দেশব্যাপী তা জরিপ করেছে আইএফপিআরআই। ওই জরিপের তথ্য মতে, শুধু বোরো আবাদে মোট খরচ হয় ৬৪ হাজার ৮৬২ কোটি টাকা। এর মধ্যে সেচ বাবদ খরচ হয় ১৪ হাজার ৭৫ টাকা। এটা বোরোর মোট খরচের ২১.৭ শতাংশ।
এর বাইরে ৩৬.২ শতাংশ খরচ হয় শ্রমিকের মজুরি বাবদ। সারের খরচ ১৫.৯ শতাংশ। বীজ ও বীজ বপন-রোপণ খরচ ১২.১ শতাংশ; উপকরণ, যন্ত্রপাতি খরচ ৯.৪ শতাংশ এবং বালাইনাশকে ৪.৭ শতাংশ খরচ হয়।
সংস্থাটির এই তথ্য বিবেচনায় নিলে প্রতি হেক্টর জমিতে জ্বালানি খরচ বাড়বে প্রায় পাঁচ হাজার ৯৮২ টাকা। গত অর্থবছরে ৪৮ লাখ ৭২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ভবিষ্যতে একই পরিমাণ আবাদ হলে খরচ বাড়বে দুই হাজার ৯১৪ কোটি টাকা। তবে সার্বিক কৃষি খাতে খরচ আরো বেশি হবে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) তথ্য মতে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ১৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪১৩টি সেচযন্ত্র ছিল। এর মধ্যে ১২ লাখ ৪৫ হাজার ৫০৭টি সেচযন্ত্র চলেছে ডিজেলে। অর্থাৎ ডিজেলে চলে প্রায় ৭৮.৪৩ শতাংশ সেচযন্ত্র। এর পাশাপাশি কৃষিযন্ত্র এবং পরিবহনে ডিজেলের ব্যবহার আছে। এই হিসাবে গত ২০২০-২১ অর্থবছরে কৃষি খাতে ডিজেল ব্যবহৃত হয়েছে ৯ লাখ ৭৫ হাজার ৫৩৯ টন। এই তেল কিনতে কৃষককে ব্যয় করতে হয়েছে প্রায় সাত হাজার ৮০৪ কোটি টাকা। নতুন দামে আগামী বোরো মৌসুমে একই পরিমাণ ডিজেল ব্যবহৃত হলে কৃষককে গুনতে হবে ১১ হাজার ১২১ কোটি টাকা। ফলে সেচ, পরিবহন আর কৃষিযন্ত্র পরিচালন করতে কৃষকের বাড়তি খরচ হবে তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকা।
তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষিতে প্রভাব পড়বে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে কৃষিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. আব্দুর রাজ্জাক গতকাল জানিয়েছেন, বিদ্যুতের দাম বাড়েনি, ফলে বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রে কোনো সমস্যা হবে না। তবে সার্বিকভাবে কৃষিতে কিছুটা প্রভাব পড়বে। কিন্তু এতে কৃষি উৎপাদন কমবে না, তবে কৃষকের লাভ কমে আসবে। তিনি বলেন, ‘বিশ্ব পরিস্থিতির কারণে একটু কষ্ট হলেও আমাদের সম্মিলিতভাবে তা মোকাবেলা করতে হবে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম আরো কমলে দেশেও কমানো হবে। ’
মাঠের চিত্র
ইউরিয়া সারের দাম বাড়ানোর পর জ্বালানির দাম বৃদ্ধি দুশ্চিন্তায় ফেলেছে কৃষকদের। এদিকে চলতি আমন মৌসুমে বৃষ্টি না হওয়ায় জমিতে সেচ দিতে হচ্ছে কোথাও কোথাও। তাতে খরচ বাড়ছে। পাওয়ার টিলারে জমি চাষের খরচও বেড়ে গেছে। আর ইউরিয়ার দাম বৃদ্ধির প্রভাব তো আছেই। এ অবস্থায় কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিরও আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। বগুড়া ও যশোরের বিভিন্ন গ্রামে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য পেয়েছেন কালের কণ্ঠের যশোর ও বগুড়া প্রতিনিধি।
যশোরের এড়েন্দা গ্রামের বর্গাচাষি ফজেল আহম্মেদ জানিয়েছেন, চলতি মৌসুমে ১১ বিঘা জমি বর্গা নিয়েছেন। বর্গা বাবদ জমির মালিককে দিতে হবে ছয় মণ ধান। ১১ বিঘার মধ্যে এখনো তাঁর পাঁচ বিঘা জমি চাষ বাকি রয়েছে। তিনি বলেন, ‘পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ বাবদ বিঘেয় খরচ ছিল এক হাজার টাকা। তেলের দাম বাড়ায় চাষ খরচ আরো ২০০ টাকা বাইড়েছে। এদিকি ইউরিয়া সারের দাম বাইড়েছে। বৃষ্টির অভাবে সেচ দিয়ে চাষ দিতে যাইয়ে এমনিতিই চাষ খরচ বাইড়েছে। আগে সব মিলোয়ে বিঘেয় খরচ হতো চার হাজার ৫০০ টাকার মতোন। এখন যা দেখতিছি তাতে ছয় হাজার টাকায় কুলোবে কি না বুঝতি পারতিছিনে। সব মিলোয়ে চাষ করতি যাইয়ে গলায় দড়ি দিয়ার অবস্থা। ’
বগুড়ার সোনাতলা উপজেলার কৃষক আমিনুল ইসলাম জানান, গত আমন মৌসুমে প্রতি বিঘা জমিতে চাষের জন্য ১৮০ টাকা (একচাষ) নিয়েছেন। ডিজেলের দাম বাড়ার পর এবার বাধ্য হয়ে ২৫০ টাকা নিচ্ছেন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপপরিচালক মঞ্জুরুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ডিজেলের মূল্য বৃদ্ধিতে কৃষকের কিছুটা খরচ বাড়বে। তবে ভবিষ্যতে বৃষ্টির পূর্বাভাস আছে। আর কৃষকদের জন্য সরকারের প্রণোদনা কর্মসূচি থাকে। কৃষিকাজে যেন বিঘ্ন না হয় সরকার সেদিকে বিশেষ নজর রাখবে।
এ জাতীয় আরো খবর..