×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৮-১৩
  • ৯২ বার পঠিত
জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর নতুন বাসভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। তবে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। বাসের ‘সিটিং সেবা’ ও ‘ওয়েবিলের’ নামে কোথাও কোথাও দুই কিলোমিটার পথের জন্য ১৫ টাকা পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া বন্ধে সরকারি সংস্থা ও বাস মালিক সমিতির কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছে যাত্রীরা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত বছরের নভেম্বরে যখন বাসের ভাড়া বাড়ানো হয়, তখনই সিটিং সেবা বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সেই সিটিং সেবা এখনো অনেক বাস কম্পানি চালিয়ে যাচ্ছে। তখন বাসের ওয়েবিল বন্ধের ঘোষণা না এলেও সম্প্রতি ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি ওয়েবিল বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু সড়কে ওয়েবিল এখনো চলমান।  

মূলত বিভিন্ন জায়গায় থামিয়ে বাসে কত যাত্রী আছে সেটা একটা নির্দিষ্ট কাগজে লিখে রাখার প্রথাকে ‘ওয়েবিল’ বলা হয়। এই ওয়েবিল পদ্ধতি ‘চেকার’ ও ‘চেকিং পয়েন্ট’ নামেও পরিচিত। ওয়েবিলের জায়গার ওপর ভিত্তি করে বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়। এতে কিলোমিটারপ্রতি নির্ধারিত ভাড়ার হিসাব থাকে না।   

উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজধানীর আজিমপুর থেকে একটি বাস নীলক্ষেত, আসাদগেট, খামারবাড়ি, বিজয়নগর, বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর গেট, মহাখালী, বনানী, কুড়িল বিশ্বরোড, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর, টঙ্গী হয়ে গাজীপুর পর্যন্ত যায়। একজন যাত্রী যদি আজিমপুর বা নীলক্ষেত থেকে ওই বাসে উঠে খামারবাড়ি বা বিজয়নগর যায় তাহলে তাকে ২৫ টাকা ভাড়া দিতে হয়। আবার আসাদগেট থেকে উঠলেও ২৫ টাকাই ভাড়া দিতে হয়। যাত্রী যেখানেই নামুক না কেন, আসাদগেট থেকে বনানী পর্যন্ত ভাড়া ২৫ টাকা। বনানী পার হলেই এই ভাড়া হয়ে যায় ৪০ টাকা। কেননা, বনানীতে ওয়েবিলের একটি চেকিং রয়েছে।  

যাত্রী ও বাসসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মহাখালী-বাড্ডা রুটের বাসে বেশি যাত্রী নামে গুলশানে। তাই ওয়েবিল করা হয়েছে গুলশানের কিছুটা আগে। এতে ওয়েবিলের জায়গা পার হলেই ভাড়ায় আরো ১০ টাকা যুক্ত হয়ে যায়। আসাদগেটের পর বনানীর আগ পর্যন্ত কোনো ওয়েবিল নেই। এই পথে যাত্রী তেমন ওঠে না, নামার সংখ্যাটাই বেশি। একইভাবে ওয়েবিলের জায়গাগুলো মূলত একটি বড় বাসস্ট্যান্ডের আগে করা হয়। যেন বেশির ভাগ যাত্রীকে ওয়েবিলের আওতায় আনা যায়। এমন ওয়েবিলের ফাঁদে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায় করছেন বাস মালিকরা।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা অভিযোগ করছেন, সরকার বাস মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে যেতে পারছে না। বিআরটিএর অভিযানে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়, রুট না মানা, রুট পারমিট ছাড়া বাস চালানো এবং ফিটনেসবিহীন বাসকে জরিমানা করা হলেও ওয়েবিল প্রথা বন্ধে তোড়জোড় দেখা যায় না।

যদিও বাস মালিকরা বলছেন, বাসে কী পরিমাণ যাত্রী পরিবহন করা হলো সে হিসাব রাখতেই ওয়েবিল করা হয়। এর সঙ্গে বাসের ভাড়ার কোনো সম্পর্ক নেই।  

বাসের ভাড়া নির্ধারণ ও আদায় প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শামছুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকার বাস মালিকদের কাছে জিম্মি হয়ে আছে। কিছু হলেই বাস মালিকরা সরকারকে ধর্মঘটের মতো জুজুর ভয় দেখায়। শৃঙ্খলা আনার জন্য গণপরিবহন খাতকে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা দরকার। তাহলে যাত্রীরাও প্রকৃত সেবা পাবে। ’    

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকা শহর ও শহরতলি রুটে চলাচলকারী গাড়ির ওয়েবিলে কোনো স্ল্যাব (ধাপ) থাকবে না। রাস্তায় কোনো চেকার থাকবে না। এক স্টপেজ থেকে আরেক স্টপেজ পর্যন্ত গাড়ির দরজা বন্ধ থাকবে, খোলা রাখা যাবে না। রুট পারমিটের স্টপেজ অনুযায়ী গাড়ি থামাতে হবে।

যদিও বাসে এখনো ওয়েবিল এবং অতিরিক্ত ভাড়া আদায় বন্ধ করা যায়নি। এ বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওয়েবিলে ভাড়া নির্ধারণ করা অবৈধ। তবে এত দিনের অনিয়ম দূর করতে সময় তো লাগবে। আমরা সমিতির পক্ষ থেকে বিষয়টি কঠোরভাবে নজরদারি করছি। সব বাস মালিকের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। ’  

তবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতি মনে করে, পরিবহন মালিক সমিতির মধ্যে শৃঙ্খলার অভাব রয়েছে। তাই এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হচ্ছে না। সংগঠনটির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বাসের ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে সমিতির সিদ্ধান্ত মালিকরা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর করেন। কিন্তু শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে কোনো নির্দেশনা দিলে তা কার্যকর হয় না। আমাদের পর্যবেক্ষণ মতে গত এক দশকে চার দফা বাসের ওয়েবিল ও সিটিং সার্ভিস বন্ধের ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে সরকারের যেমন পরিবহন খাতের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই, তেমনি সমিতিরও বাস মালিকদের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এসব সমস্যা সমাধানে পরিবহনের কাঠামোগত সংস্কার দরকার। ’  

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) উচ্চপদস্থ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এসব ওয়েবিল মূলত চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করতে করা হয়। সড়কে বাস থেকে যেসব খাতে চাঁদা ওঠে সেগুলো বন্ধ করা গেলে বাসভাড়া এমনিতেই প্রায় অর্ধেক কমানো সম্ভব হবে।

বর্তমানে ঢাকা মহানগরীতে বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে ২৫০টির মতো বাস রুট রয়েছে। এসব রুটে বিআরটিএর অনুমোদিত বাস রয়েছে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার। তবে ঢাকায় নিয়মিত প্রায় সাত হাজার বাস চলাচল করে। সব বাসের বৈধ রুট পারমিট না থাকায় ভাড়ার তালিকাও নেই।  

আবার রাজধানীতে সিটিং সেবা বন্ধ থাকলেও সিটিংয়ের নামে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। এতে সর্বনিম্ন ভাড়া ১০ টাকা মানা হচ্ছে না। মালঞ্চ নামের এক বাসে এখনো সিটিং সেবার নামে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া নিতে দেখা যায়। এই বাসে সূত্রাপুর থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত ভাড়া নেওয়া হচ্ছে ২৫ টাকা, শাহবাগ পর্যন্ত ৪০ টাকা। আর সূত্রাপুর থেকে মোহাম্মদপুর এলে দিতে হয় ৫৫ টাকা। যদিও সূত্রাপুর থেকে মোহাম্মদপুরের দূরত্ব ১২ কিলোমিটার।  

আবার বিআরটিএর ভাড়ার তালিকায় ফাঁক রয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় এক বাসস্ট্যান্ড থেকে আরেক বাসস্ট্যান্ডের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। এর মধ্যে কোথাও নামলেও যাত্রীকে পরের বাসস্ট্যান্ডের ভাড়া দিতে হচ্ছে।  

জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘যাত্রীদের কাছ থেকে যেন কোনোভাবেই অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া না হয় সে জন্য আমরা মাঠে কাজ করছি। নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের প্রমাণ পেলে বাসকে জরিমানা করা হচ্ছে। আর বাসস্ট্যান্ড তো কোথাও না কোথাও দিতেই হবে। ’

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat