ফার্সিভাষীরা হাফিজকে বলেন ‘লিসানুল গায়েব’, মানে অদৃশ্যের ভাষা। কবি হাফিজ তাঁর দিওয়ানের পাতায় পাতায় যে কাব্যভাষা রেখে গেছেন, তা মানবমনের সব অদৃশ্য আকুতিকে যথার্থ ভাষা দেয়। ফার্সিভাষীরা তাই চোখ বন্ধ করে দিওয়ানে হাফিজের পাতায় আঙুল রাখলে কাঙ্ক্ষিত ভাষা খুঁজে পেয়ে যান। তেমনি বাঙালির জীবন জিজ্ঞাসার এমন কোনো বিষয় নেই, যা লিখে যাননি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
প্রেমিকের বিশেষ মুহূর্তের গোপন কথাটিও যেন তিনি কী করে জেনে গিয়েছিলেন। তিনি মুখে ভাষা তুলে দিতে আনাড়ি প্রেমিককে আহ্বান করেন, ‘সে কি আমার কুঁড়ির কানে/কবে কথা গানে গানে। ’
রবীন্দ্র জন্মের শতবর্ষ পরে আজও তাই কোনো প্রেমিক যখন ভাষা হারিয়ে ফেলে তখন রবীন্দ্রনাথের কবিতা ও গানই হয়ে ওঠে তার পরম আশ্রয়। ভাষা পাওয়া প্রেমিকমন তখন যেন কৃতজ্ঞতায় রবীন্দ্রনাথের গানই গুন গুন করে গেয়ে ওঠে, ‘তোমারি ঝরনাতলার নির্জনে/মাটির এই কলস আমার ছাপিয়ে গেল কোন্ ক্ষণে’। প্রগতিশীল উর্দুভাষী কবি হামিদুল্লাহ আফসার বলতেন, যার এক হাতে ‘দিওয়ানে হাফিজ’ আরেক হাতে ‘গীতাঞ্জলি’, তার চেয়ে ধনী আর কে আছে!
আজ থেকে ৮১ বছর আগের এই দিনটিতে কবিগুরু পাড়ি জমান আরেক ভুবনে। ক্যালেন্ডারের হিসাবে দিনটি ছিল ২২শে শ্রাবণ। আনন্দ-বেদনায়, দুঃখে-হর্ষে, সংকটে, সংকল্পে, সংগ্রামে তাঁকে একান্ত আপন করে পায় বাঙালি। বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বদরবারে বিশেষ মর্যাদার আসনে পৌঁছে দেওয়ার কীর্তি তাঁর। ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে/....তখন কে বলে গো সেই প্রভাতে নেই আমি’—গানের পঙিক্ততে এভাবেই নিজের অমরত্বের আশাবাদ ব্যক্ত করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই। নিজের সৃষ্টির মধ্য দিয়ে তিনি বেঁচে আছেন বাঙালির মনের মণিকোঠায়।
মৃত্যুকে নিয়ে কি ভয় ছিল রবীন্দ্রনাথের? চলে যাওয়া নিয়ে কী ভাবতেন তিনি? এ ব্যাপারে অনেকভাবেই লিখেছেন তিনি। মৃত্যুর বছর দুয়েক আগে নিজের ডায়েরিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘মরে যাবার পরেও লোকে কেন যে কামনা করে, তাদের নিয়ে হৈচৈ হোক, তাদের লেখার, কীর্তির গুণগান হোক। এত বড় মূর্খতা এই মানুষেরাই করে। এর চেয়ে বড় বোকামি আর কিছুতেই হতে পারে না। আরে, মরেই যদি গেলুম, তার পর তা নিয়ে কী হলো না হলো, তা নিয়ে কী এলো আর গেল। লিখছি, নিজে আনন্দ পাচ্ছি; এই তো যথেষ্ট। এর চেয়ে বেশি চাওয়া আর কাকে বলে। ’
রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে আবিষ্কার করেছিলেন অমৃত করে। তিনি বিশ্বাস করতেন মহৎ মানবাত্মার কোনো বিলয় নেই। ‘মৃত্যুর পরে’ কবিতায় রবীন্দ্রনাথ মৃত্যুকে সব শান্তির অতল আশ্রয় হিসেবে দেখেছেন। মৃত্যু যেন সব পরিণতির এক অসীম আনন্দলোক। কবি লিখেছেন, ‘সব তর্ক হোক শেষ/ সব রাগ সব দ্বেষ/সকল বালাই/বলো শান্তি, বলো শান্তি/ দেহ-সাথে সব ক্লান্তি/পুড়ে হোক ছাই। ’
রবীন্দ্রনাথকে বলা হয়, আধুনিক বাঙালির রুচির নির্মাতা। অসামান্য প্রতিভায় বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে আপন আলোয় উদ্ভাসিত করেছেন। কাব্য, সংগীত, উপন্যাস, ছোটগল্প, নাটক, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, চিত্রশিল্প, শিশুতোষ রচনাসহ শিল্প-সাহিত্যের প্রায় সব শাখায় তাঁর হাতে সোনা ফলেছে। বিপুল তাঁর সৃষ্টিসম্ভার। মৃত্যুর সাত দিন আগেও ছিলেন সৃষ্টিশীল।
লিখেছেন, ‘তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছো আকীর্ণ করি/বিচিত্র ছলনা-জালে/হে ছলনাময়ী/মিথ্যা বিশ্বাসের ফাঁদ পেতেছ নিপুণ হাতে/সরল জীবনে/এই প্রবঞ্চনা দিয়ে মহত্ত্বেরে করেছ চিহ্নিত;/তার তরে রাখনি গোপন রাত্রি। ’
তাঁর লেখা দুনিয়ার প্রায় প্রধান সব ভাষায়ই অনূদিত হয়েছে। বাংলার পাশাপাশি নিজেও ইংরেজিতে লিখেছেন। ১৯১৩ সালে প্রথম বাঙালি হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন তিনি। জমিদার পরিবারের সন্তান রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যের বাইরেও সমাজ সংস্কার, শিক্ষা, পল্লী পুনর্গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন।
আজ শনিবার প্রয়াণদিবসে কবিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে তাঁর ভক্ত-শুভানুধ্যায়ীরা। সন্ধ্যা ৭টায় ধানমণ্ডির ছায়ানট মিলনায়তনে দিবসটি উপলক্ষে কথা, পাঠ ও সংগীতের মধ্য দিয়ে কবিকে স্মরণ করবে সংগীত বিদ্যায়তন ছায়ানট। জাতীয়সংগীত ও নৃত্যকলাকেন্দ্র মিলনায়তনে সাড়ে ৬টায় ‘শিল্পের আলোয় শ্রদ্ধাঞ্জলি : রবীন্দ্রনাথ ও বঙ্গবন্ধু’ শীর্ষক আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি।
এ জাতীয় আরো খবর..