এক ট্রেনের ধাক্কায় নিমিষেই ঝরে যায় ১১ প্রাণ। মিরসরাইয়ের খৈয়াছড়ার পূর্ব খৈয়াছড়া গ্রামের ঝরনা থেকে কিছুটা দূরেই রেলের লেভেলক্রসিং। ট্রেন আসছিল কি না তা জানা ছিল না তাদের কারোই। তবে এই লেভেলক্রসিংটি ছিল বৈধ এবং রক্ষিত।
২০১৯ সালের ১৫ জুলাইয়ের কথা। সেদিনও সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় লেভেলক্রসিংয়ে ট্রেনের ধাক্কায় মাইক্রোবাস দুমড়েমুচড়ে নিহত হন বর-কনেসহ ১১ জন। তবে সেই ক্রসিংটি ছিল অরক্ষিত। যদিও এই দুই দুর্ঘটনার ক্ষেত্রেই রেলের গেটম্যান ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না বলে জানা যাচ্ছে।
লেভেলক্রসিংয়ে এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, দুর্ঘটনার পর প্রায় প্রতিবারই তদন্ত কমিটি করা হয়। তারপর গেটম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েই সমাধান টানা হয়। এসব দুর্ঘটনা রোধে রেলের নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা।
এক হিসাবে দেখা যায়, শুধু চলতি মাসেই লেভেলক্রসিংয়ে ১০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ২৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। অরক্ষিত রেলপথ, অবৈধ লেভেলক্রসিং, বৈধ লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যানের অভাব এবং চলাচলকারীদের অসচেতনতাকেই দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, সমস্যা চিহ্নিত করে সমাধান না করায় দুর্ঘটনা ঘটছে।
লেভেলক্রসিংয়ে মৃত্যু কমছে না
রেলওয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত ১২ বছরে রেললাইনে দুই হাজার ৬০১টি দুর্ঘটনা ঘটে। এতে ট্রেনের চলার পথে বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় দুর্ঘটনা হয়েছে ২৫৮ বার। এসব দুর্ঘটনায় ৩৪৩ জন মারা গেছে। দুর্ঘটনায় নিহতদের মধ্যে ট্রেনের যাত্রী ৩২ জন এবং রেলের কর্মরত ৪৩ জন। অথচ রেল দুর্ঘটনার কারণে ট্রেনের বাইরে সড়কে মৃত্যু হয়েছে ২৬৮ জনের। অর্থাৎ রেল দুর্ঘটনায় ট্রেনে যত মানুষ মারা যায় তার থেকে অন্তত সাড়ে তিন গুণ বেশি মানুষ মারা যায় সড়ক দুর্ঘটনায়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ছয় বছরে রেলপথে ৯৭৪টি দুর্ঘটনায় এক হাজার ৫৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এসব দুর্ঘটনার মধ্যে ১১৬টি হয়েছে লেভেলক্রসিংয়ে। এই ১১৬ দুর্ঘটনায় ১৭৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। রেল দুর্ঘটনায় আহত হয়েছে এক হাজার তিনজন। লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার কারণে ৩১৪ জন আহত হয়েছে।
মৃত্যুর দায় নিতে প্রস্তুত নয় রেল
রেল কর্তৃপক্ষের ভাবনা, রেলপথে দুর্ঘটনায় মৃত্যুর জন্য রেল সরাসরি দায়ী নয়। রেল নিজস্ব পথে চলে, সড়কে নয়। আর অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনা বা মৃত্যুর দায় রেল আর নেবে না। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলছেন, অবৈধ লেভেলক্রসিং দেখার দায়িত্ব রেলের নয়। রেল শুধু বৈধ লেভেলক্রসিং পরিচালনা করে থাকে।
জানতে চাইলে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (পরিচালন) সরদার শাহাদাত আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের যেসব প্রতিষ্ঠান অবৈধ লেভেলক্রসিং তৈরি করেছে তাদের সঙ্গে আমরা আলোচনা করেছি। সেগুলো বৈধ করার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সেসব লেভেলক্রসিং রেলের নজরদারিতে চলে এলে দুর্ঘটনা কমবে। ’
তিনি বলেন, ‘আজকে (গতকাল) যে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটা বৈধ গেট ছিল। শোনা যাচ্ছে, সেখানে দায়িত্বরত গেটম্যান ও সিগন্যালও ছিল। মাইক্রোবাসটি সিগন্যালের পাশ দিয়ে রেললাইনের ওপর উঠে যায়। ঘটনার সত্য-মিথ্যা তদন্তের পর বোঝা যাবে। ’
ট্রেন দুর্ঘটনায় এমন মৃত্যুর দায় মূলত কার— এমন প্রশ্নে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রেলওয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বলেন, ‘যারা দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে তাদের দায়ই বেশি। তাদের দেখেশুনে রেললাইন পার হওয়া উচিত। আমরা সড়কপথ পার হওয়ার সময় বারবার রাস্তার দুই পাশে তাকাই। কিন্তু রেলের বেলায় কেন সেটা মানব না। ট্রেন চাইলেই থামানো যায় না। আমাদের বাস্তবতায় পুরো রেলপথ বেড়া দিয়ে ঘিরে রাখাও সম্ভব না। মানুষ সচেতন হলেই দুর্ঘটনা কমবে। ’
অরক্ষিত লেভেলক্রসিং বেশি
রেলওয়ের তথ্য বলছে, সারা দেশে তিন হাজার কিলোমিটার রেলপথ রয়েছে। পুরো পথে আছে তিন হাজার ৩৯৮টি লেভেলক্রসিং। এর মধ্যে এক হাজার ৩৬১টি অবৈধ। আর বৈধ-অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে অরক্ষিত দুই হাজার ৫৪টি। অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের বেশির ভাগেই স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ (এলজিইডি) ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) রাস্তা।
এআরআইয়ের গবেষণার তথ্য বলছে, দেশের মোট অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ের মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ ও এলজিইডির রাস্তা রয়েছে ৪২৭টি করে, সড়ক ও জনপথ বিভাগের ২৪টি, পৌরসভার ১১০টি, সিটি করপোরেশনের ৩২টি, একাধিক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের রয়েছে ২৭টি, জেলা পরিষদের ১৩টি এবং চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তিনটি। এ ছাড়া ১২৭টি লেভেলক্রসিং কার আওতায় আছে, তা জানা যায়নি।
এআরআইয়ের পরিচালক অধ্যাপক হাদিউজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, লেভেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় মৃত্যু নিয়মিত ঘটনায় পরিণত হয়েছে। তবু রেল কার্যকরী কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না। যেসব অবৈধ লেভেলক্রসিং রয়েছে সেগুলোর বেশির ভাগই বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের। রেলের উচিত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলোচনা করে ব্যবস্থা নেওয়া। রেলের হাজার হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প চলমান রয়েছে, কিন্তু গোড়াতে ঠিক নেই।
লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যানের অভাব
একটি লেভেলক্রসিংয়ে ২৪ ঘণ্টা দায়িত্বরত গেটম্যান থাকা জরুরি। সে হিসাবে প্রতি লেভেলক্রসিংয়ে তিনজন গেটম্যান থাকার কথা। রেলের গেটম্যানদের চাকরি স্থায়ী করা নিয়ে আন্দোলন করা সংগঠন বাংলাদেশ রেলওয়ে ১৮৮৯০ গেটকিপার রাজস্ব বাস্তবায়ন ঐক্য পরিষদ পূর্ব পশ্চিম অঞ্চলের সমন্বয়কারী আল মামুন শেখ জানান, বর্তমানে সারা দেশে পাঁচ হাজার ২৫ জন গেটকিপার কর্মরত রয়েছেন। অথচ তিন হাজার ৩৯৮টি লেভেলক্রসিংয়ের জন্য ১০ হাজার ১৯৪ জন গেটম্যান প্রয়োজন।
গেটম্যান না থাকা প্রসঙ্গে রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (আবকাঠামো) কামরুল আহসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দুই-আড়াই হাজারের মতো লেভেলক্রসিংয়ে গেটম্যান নেই। এসব গেটের বেশির ভাগই অবৈধ। অবৈধ লেভেলক্রসিংয়ে আমরা গেটম্যান নিয়োগ দেব না। এটা আমাদের দায়িত্ব নয়। আবার যেসব বৈধ গেটে দিয়ে ২-৫টা ট্রেন যায়, সেখানেও গেটম্যান নিয়োগ দিয়ে জনবল বাড়ানো ঠিক হবে না। তবে এসব গেটে আমরা সংকেত পদ্ধতি চালু করার পরিকল্পনা নিচ্ছি। এতে ট্রেন এক কিলোমিটার দূরে থাকতেই সংকেত বেজে উঠবে। ’
এ জাতীয় আরো খবর..