এবারের ঈদুল আজহায় সারা দেশে ৩১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে আরো ৭৭৪ জন। ঈদ যাত্রা শুরুর দিন ৩ জুলাই থেকে ঈদ শেষে কর্মস্থলে ফেরা ১৭ জুলাই পর্যন্ত ১৫ দিনে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। এই সংখ্যা গত ছয় ঈদুল আজহার তুলনায় সর্বোচ্চ।
এবার ঈদুল আজহায় সড়ক, রেল ও নৌপথ মিলিয়ে ৩৫৪টি দুর্ঘটনায় ৪৪০ জনের মৃত্যু এবং ৭৯১ জন আহত হয়েছে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল মঙ্গলবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির পক্ষ থেকে ‘ঈদ যাত্রায় সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিবেদন-২০২২’ প্রকাশ করা হয়। জাতীয় দৈনিক, আঞ্চলিক দৈনিক ও অনলাইন সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির তথ্য মতে, ২০১৬ সালে ঈদুল আজহায় ১৯৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৪৮ জন মারা গেছে। ২০১৭ সালে ২১৪টি দুর্ঘটনায় ২৫৪ জন মারা গেছে। ২০১৮ সালে ২৩৭টি দুর্ঘটনায় ২৫৯ জন মারা গেছে। ২০১৯ সালে ২০৩টি দুর্ঘটনায় ২২৪ জন, ২০২০ সালে ২০১টি দুর্ঘটনায় ২৪২ জন এবং ২০২১ সালে ২৪০টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২৭৩ জন মারা যায়।
যাত্রী কল্যাণের এবারের প্রতিবেদনে দেখা যায়, বরাবরের মতো এবারও দুর্ঘটনার শীর্ষে রয়েছে মোটরসাইকেল। ঈদুল আজহায় ১১৩টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় ১৩১ জনের মৃত্যু এবং ৬৮ জন আহত হয়েছে, যা মোট সড়ক দুর্ঘটনার ৩৫.৪২ শতাংশ এবং নিহতের ৩২.৯১ শতাংশ।
দুর্ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, মোট যানবাহনের ২৯.০৩ শতাংশ মোটরসাইকেল, ২৩.১৮ শতাংশ ট্রাক-পিকআপ-কাভার্ড ভ্যান-লরি, ৫.৬২ শতাংশ কার-মাইক্রো-জিপ, ৩.৯৮ শতাংশ নছিমন-করিমন-ট্রাক্টর-লেগুনা-মাহিন্দ্রা, ১১.৪৭ শতাংশ অটোরিকশা, ৯.৩৬ শতাংশ ব্যাটারি রিকশা-ইজি বাইক-ভ্যান-সাইকেল ও ১৭.৩৩ শতাংশ বাস এসব দুর্ঘটনায় জড়িত।
সংঘটিত দুর্ঘটনার ২৩.১৯ শতাংশ মুখোমুখি সংঘর্ষ, ৫০.৭৮ শতাংশ পথচারীকে গাড়িচাপা দেওয়ার ঘটনা, ১৮.৪৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ার ঘটনা, ৬.৮৯ শতাংশ অন্যান্য অজ্ঞাত কারণে এবং ০.৩১ শতাংশ চাকায় ওড়না পেঁচিয়ে দুর্ঘটনা সংঘটিত হয়েছে।
মোট দুর্ঘটনার ৩২.৯১ শতাংশ জাতীয় মহাসড়কে, ৪৬.৭০ শতাংশ আঞ্চলিক মহাসড়কে, ১৫.৩৬ শতাংশ ফিডার রোডে সংঘটিত হয়েছে। এ ছাড়া সারা দেশে সংঘটিত মোট দুর্ঘটনার ৪.৭০ শতাংশ রাজধানীতে সংঘটিত হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনের মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘৩৭ লাখ মোটরসাইকেল বন্ধ থাকার পরও এবং এবার ঈদ যাত্রায় ৯ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা কমলেও গত বছরগুলোর হিসাবে এবারের ঈদ যাত্রায় সর্বোচ্চ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি হয়েছে। এতে প্রমাণিত হয়, কোনো একটি নির্দিষ্ট যানবাহন বন্ধ করে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব নয়। এ জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, ব্যাপক কর্মপরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ। ’
সংবাদ সম্মেলনে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘যাত্রী কল্যাণ বা সড়ক নিরাপত্তার চেয়ে গোষ্ঠীরস্বার্থ বেশি দেখার কারণে অর্থনীতির লাইফলাইন খ্যাত এই বিশাল পরিবহন সেক্টরে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাচ্ছে না। ফলে সড়ক দুর্ঘটনা বা সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো কঠিন হয়ে পড়েছে। গণপরিবহনে গুরুত্ব পায় না বলেই মোটরসাইকেল ও ইজি বাইকের দৌরাত্ম্য বাড়ছে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি। ’
সংবাদ সম্মেলনে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা কেন্দ্রের সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘সড়ক বিভাজক না থাকার কারণে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা বাড়ছে। এ ছাড়া পথচারীর জন্য নিরাপদ ফুটপাত না থাকায় পথচারীর মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। এই দুটি বিষয়ে মনোযোগী হলে উল্লেখযোগ্য হারে দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব। ’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বেপরোয়া গতি, জাতীয় মহাসড়কে রোড সাইন বা রোড মার্কিং, সড়কবাতি না থাকায় ঈদে যাতায়াতকারী ব্যক্তিগত যানের চালকরা রাতে এসব জাতীয় সড়কে ঝুঁকি নিয়ে যানবাহন চালান। জাতীয়, আঞ্চলিক ও ফিডার রোডে টার্নিং চিহ্ন না থাকায় নতুন চালকরা এসব সড়কে দুর্ঘটনায় পতিত হন। মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, যানবাহনের ত্রুটি, ট্রাফিক আইন অমান্য করার প্রবণতা; উল্টো পথে যানবাহন চালানো, সড়কে চাঁদাবাজি, পণ্যবাহী যানে যাত্রী পরিবহন এবং মোটরসাইকেল, ইজি বাইক, অটোরিকশার সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ায় দুর্ঘটনা বাড়ছে।
সড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে জাতীয় ও আঞ্চলিক মহাসড়কে রাতেরবেলায় চলাচলের জন্য আলোর ব্যবস্থা করা, দক্ষ চালক তৈরির উদ্যোগ নেওয়া, যানবাহনের ত্রুটি সারানো, ধীরগতির যান ও দ্রুতগতির যানের জন্য আলাদা লেন করা, মানসম্মত সড়ক নির্মাণ ও মেরামত সুনিশ্চিত করা, নিয়মিত রোড সেফটি অডিট করাসহ আটটি সুপারিশ করা হয়েছে।
এ জাতীয় আরো খবর..