দুটি আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের চক্র, দুটি ৫০ ওভারের বিশ্বকাপ, দুটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ও দুটি চ্যাম্পিয়নস ট্রফি রেখে সাজানো হচ্ছে আগামী চার বছরের আইসিসির ভবিষ্যৎ সফর পরিকল্পনা (এফটিপি)। এর বাইরে দ্বিপক্ষীয় সিরিজ তো আছেই। তবে ২০২৩ থেকে ২০২৭ সালের এই চক্রের মূল গল্প এটি নয়। সদস্যদেশগুলো ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্টের জন্য বছরের বিভিন্ন সময় জায়গা ফাঁকা রাখছে। টি-টোয়েন্টি লিগের জন্য সময় ফাঁকা রেখেই হচ্ছে আইসিসির নতুন এফটিপি।
আইসিসির আগের চক্রেও ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগের জন্য সময় ফাঁকা রাখা ছিল। কিন্তু সেটি এতটা নির্দিষ্ট করে নয়। নতুন চক্রে টি-টোয়েন্টি লিগের সংখ্যাও বাড়তে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে লিগের সময়সীমাও বাড়ছে। তাতে এক লিগের সঙ্গে আরেক লিগের সূচিতে সংঘর্ষও হচ্ছে।
আইপিএলের কথাই ধরুন। ২০১৪ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত আইপিএল ছিল ৮ দল ও ৬০ ম্যাচের লিগ। সাধারণত মার্চের শেষ সপ্তাহে শুরু হওয়া আইপিএল চলত জুনের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত। ২০২২ সালে আইপিএলে দুটি দল বাড়ায় ম্যাচের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৭৪। গত জুনে আইপিএলের নতুন সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রির পর ২০২৩ সাল থেকে আইপিএলের ম্যাচ সংখ্যা আরও বাড়ছে। আইপিএল এখন ৯৪ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি লিগ। ভারত এখন এত ম্যাচ আয়োজনের জন্য এফটিপিতে আরও দুই সপ্তাহ সময় যোগ করতে চাইছে।
শুধু ভারত নয়, ইংল্যান্ড তাদের দ্য হান্ড্রেড টুর্নামেন্টের জন্যও সময় ফাঁকা রাখছে, অস্ট্রেলিয়া রাখছে বিগ ব্যাশের জন্য। আইপিএলের সময় সাধারণত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট হয় না বললেই চলে। ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া অবশ্য এখন পর্যন্ত দ্য হান্ড্রেড ও বিগ ব্যাশের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটও আয়োজন করে আসছে। ক্রিকইনফো বলছে, নতুন এফটিপিতে ইংল্যান্ডও তাদের এক শ বলের টুর্নামেন্টের সময় আন্তর্জাতিক সূচি ফাঁকা রাখছে। ইসিবি চাইছে, হান্ড্রেডের সময় যেন বেন স্টোকস, জো রুটদের আন্তর্জাতিক ব্যস্ততা না থাকে।
অস্ট্রেলিয়াও তাদের বড় তারকাদের বিগ ব্যাশে অংশ নেওয়ার সুযোগ করে দিতে চাইছে। ক্রিকইনফোকে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাহী নিক হকলে বলছেন, জানুয়ারি মাসটা তাঁরা সাদা বলের ক্রিকেটের জন্য ফাঁকা রাখতে চান। যেন এ সময় অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের বড় তারকারা বিগ ব্যাশে অংশ নিতে পারেন।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ, বাংলাদেশ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও পাকিস্তানও নিজ নিজ টি-টোয়েন্টি লিগের জন্য সময় ফাঁকা রাখছে। আগস্ট থেকে সেপ্টেম্বরের সময়টা সিপিএলের জন্য বরাদ্দ রেখেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এ সময় হাতে গোনা কিছু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবে ক্যারিবীয়রা। দক্ষিণ আফ্রিকা অনেক চেষ্টার পর তাদের টি-টোয়েন্টি লিগ মাঠে নামাতে যাচ্ছে। সে জন্য এর মধ্যেই টি-টোয়েন্টি লিগকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে ২০২৩ বিশ্বকাপে সরাসরি অংশগ্রহণের সম্ভাবনাকে ঝুঁকির মুখে ফেলেছে।
আগামী বছরের শুরুতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তিন ম্যাচ টেস্ট সিরিজের পর দুই দলের ওয়ানডে সিরিজ খেলার কথা। ওয়ানডে সিরিজটি আবার তাদের টি-টোয়েন্টি লিগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তাই প্রথমে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াকে ওয়ানডে সিরিজের সূচি বদলানোর প্রস্তাব দিয়েছিল ক্রিকেট দক্ষিণ আফ্রিকা। সেটিতে নেতিবাচক সাড়া পাওয়ায় ওয়ানডে সিরিজটি বাতিলই করে দিয়েছে প্রোটিয়া ক্রিকেট বোর্ড।
তিন ম্যাচের সিরিজটি না খেললে ওয়ানডে সুপার লিগের ৩০ পয়েন্ট যাবে অস্ট্রেলিয়ার পকেটে। সুপার লিগের তালিকায় ১১তম দল দক্ষিণ আফ্রিকার সরাসরি বিশ্বকাপে খেলা তখন কঠিন হয়ে যাবে। কিন্তু দেশের বিশ্বকাপ নিশ্চিত করার আগে দক্ষিণ আফ্রিকা ক্রিকেট বোর্ড চাইছে আর্থিক সচ্ছলতা। সে জন্য বাধ্য হয়েই তাদের এই সিদ্ধান্ত নেওয়া।
পাকিস্তানের চ্যালেঞ্জ আরও জটিল। রোজার মাসে পাকিস্তান সুপার লিগ (পিএসএল) আয়োজন করতে চায় না দেশটির ক্রিকেট বোর্ড। কারণ, রোজার মাসে বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো পিএসএলে বিনিয়োগ করতে চায় না। তাই রমজান মাস মাথায় রেখে পিএসএলের সূচি করছে পিসিবি। ২০২৩ সালে ফেব্রুয়ারি-মার্চ, ২০২৪ সালে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি ও ২০২৬-২৭ সালে ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে পিএসএলের জন্য সময় ফাঁকা রেখেছে পিসিবি।
তবে পিএসএলের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে ২০২৪-২৫ মৌসুম। ২০২৪ সালের শেষের দিকে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের সিরিজ আছে পাকিস্তানের। এরপর অস্ট্রেলিয়া, জিম্বাবুয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা ও নিউজিল্যান্ড সফর করবে পাকিস্তান। ঠিক এর পরেই ঘরের মাঠে চ্যাম্পিয়নস ট্রফি আয়োজন করার কথা পিসিবির, যা ১৯৯৬ সালের পর পাকিস্তানের প্রথম আইসিসি টুর্নামেন্ট।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফি শেষ হওয়ার কথা ৯ মার্চ। তত দিনে রমজান শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। পিএসএল আয়োজনের উপায় তখন দুটি, হয় অস্ট্রেলিয়া ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে সিরিজ বাতিল করে পিএসএল আয়োজন করা, না হয় মার্চের মাঝামাঝি সময় পিএসএল আয়োজন করা। কিন্তু মার্চে পিএসএল হলে আবার সেটি আইপিএলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে।
চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে বিপিএলকেও। সর্বশেষ বিপিএলের সময় বিপিএলের গভর্নিং কাউন্সিলের সদস্যসচিব ইসমাইল হায়দার প্রথম আলোকে বলছিলেন, ‘আমরা একটা নির্দিষ্ট সময় চাই বিপিএলের জন্য। নতুন যে এফটিপিটা হবে, সেখানে আশা করি সেটা পেয়ে যাব। সেটা হয়ে গেলেই আমরা বিপিএলটাকে আরও গুছিয়ে নিতে পারব।’ নতুন এফটিপিতে বিসিবি জানুয়ারি মাসটা ফাঁকা রাখতে চেয়েছে। কিন্তু এ সময় বিগ ব্যাশ, পিএসএল, দক্ষিণ আফ্রিকার নতুন টি-টোয়েন্টি লিগও মাঠে গড়াবে। এত লিগের ভিড়ে বিপিএলে বড় তারকারা খেলতে আসবেন কি না, সেটাই এখন দেখার অপেক্ষা।
তবে একটা ব্যাপার পরিষ্কার, আইসিসির নতুন চক্রে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগকে জায়গা করে দিতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের ওপর চাপ বাড়বে। ক্ষতিটাও শেষ পর্যন্ত হবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটেরই।
এ জাতীয় আরো খবর..