পদ্মা সেতু দিয়ে মোটরসাইকেল পারাপারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা চলমান রয়েছে। অন্যদিকে, ফেরিতেও পদ্মা নদী পারাপার বন্ধ। তাই কৌশলে মোটরসাইকেল পিকআপে তুলে সেগুলো ত্রিপলে ঢেকে মালামালের গাড়ি বলে পদ্মা সেতু পার করছেন দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মোটরসাইকেল আরোহীরা।
গতকাল সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত দেখা গেছে, দুই প্রান্তের টোল প্লাজায় মোটরসাইকেলবোঝাই পিকআপগুলো থেকে টোল আদায় করা হচ্ছে। একেকটি পিকআপে ১০-১২টি মোটরসাইকেল নিয়ে সেতু দিয়ে পার হতে দেখা যায়। এতে তাদের গুণতে হচ্ছে ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত। মোটরসাইকেল চালক সুজন বলেন, ‘বেলা সাড়ে ১১টায় ঢাকা থেকে ফরিদপুরের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছি। পদ্মা সেতুর টোল প্লাজায় এসে দেখি, মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ। এরপর আমি শিমুলিয়া ফেরি ঘাটে যাই। সেখানে দেখি, তেমন যানবাহন নেই। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর নিরুপায় হয়ে টোল প্লাজায় ফিরে আসি। পরে আমরা কয়েকজন মিলে একটি পিকআপ ভ্যান ভাড়া করি। মোটরসাইকেল পিকআপে তুলে দিয়েছি, সঙ্গে ড্রাইভারের পাশে একজনকে রেখেছি। এখন আমরা বাসে সেতুর পার হবো।’ তিনি আরো বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে প্রতিটি মোটরসাইকেলের জন্য ভাড়া নেওয়া হয়েছে ৫৫০ টাকা। তবে বিকালে ভীড় বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে মোটরসাইকেল প্রতি ১০০০ টাকা নেয়া হয়। স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হলো ঠিকই, কিন্তু আমাদের ভোগান্তি আরো বেড়ে গেল। আমরা এই পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চাই।’
পিকআপ চালক আমির হেসেন বলেন, ‘পদ্মা সেতুতে শুধু মোটরসাইকেল যাওয়া নিষেধ। তাই আমরা প্রতিটি পিকআপে ১০-১২ টি মোটরসাইকেল রশি দিয়ে বেঁধে সেতুর এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্তে দিয়ে আসছি।’ মাওয়া টোল প্লাজায় কর্মরত বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী তোফাজ্জল হোসেন বলেন, পিকআপ ভ্যানে মোটরসাইকেল হোক কিংবা অন্য কোনো পণ্য হোক, কাপড়/ত্রিপল দিয়ে ঢেকে পার করা হলে সেটা পণ্যবাহী গাড়ি হিসেবে ধরা হয়। সেক্ষেত্রে টোল পরিশোধ করে সেতু পার হওয়া যাবে।
যান চলাচল স্বাভাবিক: জনসাধারণের জন্য খুলে দেওয়ার তৃতীয় দিনে গৌরবের পদ্মা সেতুতে যানবাহন চলাচল ছিল একেবারেই স্বাভাবিক। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৭টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তে টোল প্লাজায় গিয়ে দেখা যায়, সকাল থেকে বাস, প্রাইভেট কার, ট্রাকসহ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন টোল প্লাজায় আসামাত্র টোল পরিশোধ করে সেতু দিয়ে পদ্মা নদী পাড়ি দিচ্ছে। দুই পাড়ের টোল প্লাজা অনেকটাই ফাঁকা ছিল। ভোগান্তি ছাড়াই সেতুতে উঠতে পারায় স্বস্তি প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন যানবাহনের যাত্রী ও চালকেরা।
এদিকে ট্রেনে পদ্মা পাড়ি দেওয়ার স্বপ্ন পূরণ হতে যাচ্ছে আগামী বছর জুন মাসে। এ জন্য দ্রুত চলছে রেললাইন নির্মাণযজ্ঞ। মূল সেতুতে রেললাইন বসানো ও স্ল্যাব ঢালাইয়ের কাজ আগামী মাসেই শুরু হবে।
বসবে স্পিড গান : সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, দুর্ঘটনা রোধে পদ্মা সেতুতে শিগগিরই বসানো হবে স্পিড গান। এছাড়া যান চলাচল মনিটরিংয়ে বসছে সিসি ক্যামেরাও। ফলে কোন যানবাহন সেতুতে আইন ভঙ্গ করলেই ধরা পড়বে। এরপর তাত্ক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে। পদ্মা সেতু চালুর প্রথম দিনেই মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় তিন জনের প্রাণহানি, সেতুর রেলিংয়ের নাট খুলে টিকটক, পদ্মা সেতুতে সিজদারত যুবকের ছবি, সেতুতে মূত্র বিসর্জনের ছবি, সেতুতে দাঁড়িয়ে নারীর টিকটক ভিডিও তৈরিসহ বিভিন্ন ঘটনা ঘটে। এগুলো নিয়ে সমালোচনা তৈরী হওয়ায় সেতু বিভাগ কঠোর হয়েছে। গতকালও দিনভর সেতুতে চালানো হয়েছে সেনাবাহিনী, পুলিশ-র্যাব ও সেতু কর্তৃপক্ষের সমন্বিত অভিযান। সেতুতে থামতে দেওয়া হচ্ছে না কোন যানবাহন। তবে অনেকে ধীর গতিতে গাড়ি চালিয়ে স্বপ্নের সেতুকে কাছ থেকে দেখার চেষ্টা করছে। অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রতিনিয়তই মাইকিং করছে ও সেতুতে টহল দিচ্ছে। সোমবার থেকেই শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে পদ্মা সেতুতে।
দ্বিতীয় দিন টোল আদায় ১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা: পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার পর প্রথম দিনে যত সংখ্যক যানবাহন পার হয়েছিল, মোটরবাইক ওঠা বন্ধের পর সেই সংখ্যা এক-চতুর্থাংশে নেমেছে; টোল আদায়ও তাই কিছুটা কম হয়। উদ্বোধনের পর প্রথম ২৪ ঘণ্টায় ৫১ হাজার ৩১৬টি যানবাহন পারাপার হয়। টোল আদায় হয়েছিল ২ কোটি ৯ লাখ ৪০ হাজার ৩০০ টাকা।
এদিকে, রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত ১৭২ কিলোমিটার রেল লাইনের কাজ চলমান রয়েছে। এই অংশের কোথাও মাটি ভরাট, কোথাও সেতু, কালর্ভাট নির্মাণ এবং রেললাইন স্থাপনের কাজ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে। ১৭২ কিলোমিটারের মধ্যে গড়ে প্রায় ৬০ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ আশা করছে, আগামী বছর জুন মাসের মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেল লাইন নির্মাণের কাজ শেষ করা সম্ভব হবে। ফলে এই সময়ের মধ্যে ঢাকা থেকে ভাঙ্গা হয়ে ফরিদপুর ও রাজবাড়ির দিকে যে রেললাইন আছে, সেখানে রেল লাইন সংযোগ তৈরি হয়ে যাবে এবং সরকার চাইলে তখন রেল চলাচল করতে পারবে।
এ জাতীয় আরো খবর..