নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপদস্থের ঘটনা এবং ঢাকার আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী কলেজের প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারকে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় দেশজুড়ে তীব্র নিন্দা, সমাবেশ ও বিক্ষোভ করেছে বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন। একই সঙ্গে বিভিন্ন সংস্থা থেকে পাঠানো বিবৃতিতে এসব ঘটনার নিন্দা জানিয়ে গভীর উদ্বেগ জানানো হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে নড়াইলের ঘটনায় অবশেষে মামলা করেছে পুলিশ। মামলার পর তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
নড়াইল সদর থানার ওসি মোহাম্মদ শওকত কবীর জানান, সোমবার রাতে প্রধান তিন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার আগে সোমবার দুপুরে মির্জাপুর পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই শেখ মোরছালিন বাদী হয়ে অজ্ঞাতপরিচয় ১৭০ থেকে ১৮০ জনকে আসামি করে নড়াইল সদর থানায় মামলাটি করেন।
গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন মির্জাপুর গ্রামের অটোচালক সৈয়দ রিমন আলী, মোবাইল ফোন ব্যবসায়ী আড়পাড়া গ্রামের শাওন খান এবং মধ্যপাড়ার মাদরাসা শিক্ষক মো. মনিরুল ইসলাম। এই তিনজনকে গতকাল মঙ্গলবার আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।
ওই ঘটনায় সারা দেশে তীব্র প্রতিবাদের মধ্যে ঘটনাটি তদন্তে শিক্ষা দপ্তর একটি কমিটি করেছে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা গত সোমবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। প্রশাসনের ঘোষণায় আগামী ১৮ জুলাই পর্যন্ত কলেজ বন্ধ রাখা হয়েছে। স্বপন কুমারের বাড়ির সামনেও রয়েছে পুলিশের পাহারা। ঘটনার দিন থেকে গতকাল পর্যন্ত তিনি বাড়ি ফেরেননি। ফলে পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন দুশ্চিন্তায়।
স্বপন কুমার বিশ্বাসের স্ত্রী সোনালী দাস কান্নাজড়িত কণ্ঠে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কী দোষ ছিল আমার স্বামীর? কেন তাকে এভাবে অপমান করা হলো? বাড়িতে নাই, কোথায় আছে, কী করছে, কিছুই জানি না। আমরা নিরাপত্তা চাই। ’
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সমাবেশ
নড়াইলে অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে অপদস্থ করার প্রতিবাদে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে সমাবেশ করেছে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট। গতকাল বিকেলে জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছের সভাপতিত্বে সমাবেশে সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, নাট্যব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ, বীর মুক্তিযোদ্ধা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, উদীচীর সহসাধারণ সম্পাদক সঙ্গীতা ইমাম, মানজার চৌধুরী সুইট, রেজিনা ওয়ালি লীনা, আহমেদ গিয়াস, আকতারুজ্জামান, কামাল পাশা চৌধুরী ও ঝুনা চৌধুরী প্রমুখ বক্তব্য দেন। গত কয়েক মাসে ঘটা শিক্ষক নির্যাতনের প্রতিবাদে সমাবেশে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের পক্ষ থেকে আগামী ১ জুলাই সারা দেশে প্রতিবাদ দিবস পালনের ডাক দেওয়া হয়েছে।
সমাবেশে বক্তারা বলেন, শিক্ষার সঙ্গে রাজনীতি, শিক্ষক ও অভিভাবকদের অবহেলা, মন্ত্রণালয় ও আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, বহুমুখী শিক্ষাব্যবস্থা এবং পাঠ্যসূচির দুর্বলতার কারণে শিক্ষাব্যবস্থা ধসে গেছে।
আসকের গভীর উদ্বেগ
আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলেছে, “গত কিছুদিন আমরা লক্ষ করছি, শিক্ষকরা লাঞ্ছিত হচ্ছেন, শিক্ষকদের শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করা হচ্ছে, এমনকি প্রাণহানির মতো ঘটনাও ঘটছে। ‘ধর্ম অবমাননা’র অভিযোগে মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলের কারাবাসের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার পর সম্প্রতি নড়াইল সদর উপজেলার মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসকে একই অভিযোগ তুলে আইন-শৃঙ্ক্ষলা রক্ষা বাহিনীর উপস্থিতিতে জুতার মালা পরিয়ে চরমভাবে হেনস্তা করা হয়। ”
আবার সাভারের আশুলিয়ার একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রের ক্রিকেট স্টাম্পের আঘাতে আহত শিক্ষক উৎপল কুমার সরকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন। আসক মনে করে, এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও যথাযথ বিচার নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
বিচার দাবি ঢাবি শিক্ষক সমিতির
গতকাল ঢাবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক নিজামুল হক ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এই দুটি ঘটনায় তীব্র নিন্দা এবং জড়িতদের দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানানো হয়।
গাইবান্ধায় বাম জোটের বিক্ষোভ
গতকাল দুপুরে গাইবান্ধা শহরের ডিবি রোডে গানাসাস মার্কেটের সামনে বাম গণতান্ত্রিক জোট গাইবান্ধা জেলা সমন্বয়ক কাজী আবু রাহেন শফিউল্লা খোকনের সভাপতিত্বে বিক্ষোভ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বাসদ (মার্ক্সবাদী) জেলা আহ্বায়ক আহসানুল হাবিব সাঈদ, কমিউনিস্ট পার্টির জেলা সাধারণ সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান মুকুল, বাসদ জেলা আহ্বায়ক গোলাম রব্বানী, ওয়ার্কার্স পার্টি (মার্ক্সবাদী) জেলা সভাপতি রেবতি বর্মণ প্রমুখ।
বক্তারা সম্প্রতি নড়াইলে সাম্প্রদায়িক উসকানিদাতা, শিক্ষক লাঞ্ছনাকারী এবং সাভারের আশুলিয়ায় শিক্ষক হত্যাকারীর গ্রেপ্তার এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানান।
সৈয়দপুরে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর বিক্ষোভ
গতকাল বিকেলে সৈয়দপুর প্রেস ক্লাবের সামনে শহীদ ডা. জিকরুল হক সড়কে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ সমাবেশে বক্তব্য দেন উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী সৈয়দপুর শাখার সহসভাপতি শফিউল ইসলাম রঞ্জু, শেখ রোবায়তুর রহমান, দলিলুর রহমান দিলু এবং সাধারণ সম্পাদক কুমার অপু বিশ্বাস প্রমুখ।
তদন্ত কমিটি গঠন
নড়াইলে কলেজ শিক্ষক স্বপন কুমার বিশ্বাসকে হেনস্তা করার নিন্দা জানিয়েছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। এ ঘটনায় উপাচার্য প্রফেসর মো. মশিউর রহমানের নির্দেশে গতকাল তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রভাষক উৎপল কুমারের হত্যাকারী তিন দিনেও গ্রেপ্তার হয়নি
আশুলিয়ায় হাজী ইউনুছ আলী কলেজের প্রভাষক উৎপল কুমার সরকারকে যে ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে, তা তিন দিন ধরে সেখানেই পড়েছিল। খবর পেয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পুলিশ এসে তা উদ্ধার করে।
বখাটে হিসেবেই এলাকায় পরিচিত ছিল আশুলিয়ায় শিক্ষক উৎপল হত্যাকারী ছাত্র জিতু। দশম শ্রেণিতে পড়লেও তার বয়স ১৯ বছর। অভিযোগ উঠেছে পরিবারের আশকারায় ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল জিতু। জিতু গ্রেপ্তার না হওয়া এবং ঘটনার তিন দিন পর হত্যাকাণ্ডের আলামত সংগ্রহ করায় প্রশ্ন উঠছে পুলিশের দায়িত্ব নিয়ে। জিতু গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত পাঠদান বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষকরা।
গতকাল দুপুরে আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকার হাজী ইউনুস আলী কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা হত্যাকারীর গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবিতে মানববন্ধন করেন। মানববন্ধনে তাঁরা ছয় দফা দাবি জানান। এ ছাড়া সাভারে উপজেলার শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে স্বাধীনতা শিক্ষক পরিষদের ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা।
ছয় দফা দাবির মধ্যে রয়েছে অবিলম্বে (৪৮ ঘণ্টা) হত্যাকারীকে গ্রেপ্তার করতে হবে। হত্যাকারীর সঙ্গে থাকা অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদেরও শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। হত্যাকারীর বাবা ও তার পরিবারের অন্য সদস্যদের আইনের আওতায় আনতে হবে। নিহতের পরিবারকে সর্বোচ্চ আর্থিক ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থী ও স্থানীয় শিক্ষার্থীদের ভেদাভেদ দূর করতে সর্বজনীন আইন প্রণয়ন করতে হবে। পুরো এলাকা থেকে কিশোর গ্যাং দূর করতে রাজনৈতিক ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে।
শিক্ষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা মানসিকভাবে চাপে আছি। যারা জড়িত তারা স্থানীয়। আমরা তো এসেছি বাইরে থেকে। তবে প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ কোনো চাপ দেয়নি। মানসিকভাবে আমরা বিভ্রান্তির মধ্যে আছি। ’
অধ্যক্ষ সাইফুল হাসান বলেন, ‘বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমরা কলেজের কোনো কার্যক্রমই করব না। এত দিন হয়ে গেলেও আসামি গ্রেপ্তার হয়নি। আমরাও তো নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করছি। জিতু তো একা না, ওর মতো আরো অনেক ছেলে আছে এলাকায়। কিন্তু আশুলিয়া থানার পুলিশ কখনো টহল দেয়নি এখানে। জিতু গ্রেপ্তার না হওয়া পর্যন্ত আমরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখব। ’
হত্যার আলামত জব্দ করতে এত সময় লাগার কারণ জানতে চাইলে আশুলিয়া থানার পুলিশ পরিদর্শক (ওসি তদন্ত) জিয়াউল ইসলাম বলেন, ‘আমাদের কাজ চলমান। আমাদের মূল টার্গেট সিসিটিভি ক্যামেরার ডিভিআর মেশিন। সেটি আজকে জব্দ করেছি। আশপাশের সিসিটিভি ক্যামেরার ফুটেজ ঘেঁটে দেখছি। স্টাম্পও জব্দ করা হয়েছে। ঘাতক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করতে আমাদের অভিযান চলমান আছে।
এ জাতীয় আরো খবর..