পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে টানাপড়েনের সময়কার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর অর্থবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান বলেছেন, ‘আমি বিশ্বব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে কিছু তথ্য ডাউনলোড করে রেখেছিলাম। এগুলো ছিল তাদের পলিসিসংক্রান্ত। ভেবেছিলাম পরে যদি কখনো লিখি তাহলে কাজে লাগবে। কিন্তু আমার ও আমার পিএসের কম্পিউটার হ্যাক করে সে তথ্যগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়।
তিনি গতকাল দুপুরে রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে পদ্মা সেতু নিয়ে আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা উপকমিটির এক জাতীয় সেমিনারে এসব কথা বলেন।
‘শেখ হাসিনার পদ্মা সেতু নির্মাণ : বিশ্ব ব্যবস্থায় বাংলাদেশ তথা উন্নয়নশীল দেশসমূহের এক যুগান্তকারী বিজয়’ শীর্ষক সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন মসিউর রহমান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। সেমিনারে বক্তৃতা করেন পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম, অর্থনীতিবিদ কাজী খলীকুজ্জমান আহমদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আইনুন নিশাত ও সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার গোলাম রহমান। মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ।
সভাপতির বক্তব্যে মসিউর রহমান পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের নানা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর ঘটনার পর বিশ্বব্যাংক এডিবি ও জাইকার সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষর করে, যেখানে বলা হয়, বিশ্বব্যাংক যদি কোথাও দুর্নীতির গন্ধ পায় তাহলে এডিবি ও জাইকাও সেখানে দুর্নীতির গন্ধ পাবে। বিশ্বব্যাংক যদি ‘না’ বলে তখন এডিবি ও জাইকা আর অগ্রসর হতে পারবে না। ফলে বিশ্বব্যাংক যখন অর্থায়ন থেকে সরে যায় তখন এডিবি ও জাইকাও সরে যায়।
মসিউর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী জাপান সরকারকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন পদ্মা সেতুসহ আরো কয়েকটি সেতুর অর্থায়নের জন্য। পরে একদিন জাপান দূতাবাস বা জাইকার একজন প্রতিনিধি আমার কাছে এসে বললেন, দুই দিনের মধ্যে আপনারা জানান, কোন বড় অবকাঠামো আগে করতে চান। আমি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, সেতু হলে আমার বাড়ি যেতে কতক্ষণ লাগবে? উত্তরে আমি বললাম, চার থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা লাগবে। আমাকে বললেন, আপনার বাড়ি যেতে কতক্ষণ লাগবে? আমি বললাম, গোপালগঞ্জ থেকে আরো দেড় ঘণ্টা, সব মিলিয়ে ছয় ঘণ্টা। উনি বললেন, তাহলে তো ভালোই। উনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়া ছিল, কত বেশি মানুষের কাছে সুফল ছড়িয়ে দেওয়া যায়।
মসিউর রহমান বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশের একটি লাভ হয়েছে, তা হলো—এ ধরনের সেতু তৈরির সক্ষমতা সম্পর্কে বিশ্বাস, আমাদের আত্মবিশ্বাস এবং সরকার, রাষ্ট্র ও জনগণের মধ্যে আত্মিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা। সেদিক দিয়ে প্রতীকী অর্জনটা টাকা-পয়সার চেয়ে অনেক বেশি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ ইট-পাথরের তৈরি নয়, এর সঙ্গে কোটি মানুষের ভালোবাসা, আবেগ, গৌরব মিশে আছে। বাঙালি জাতি যেকোনো প্রতিকূল পরিবেশে ঘুরে দাঁড়াতে পারে, এই সেতু তার প্রমাণ।
স্পিকার বলেন, ‘স্ব-অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ বৈশ্বিক অর্থনীতিকে নাড়া দিয়েছে। বিশ্বব্যাংককে তাদের বৈশ্বিক লেন্ডিং সিস্টেম নিয়ে আবার ভাবতে হবে। যারা অংশীজন তাদের সবার প্রতি ন্যায্যতা দেখাতে হবে—এটা আমরা শুনে থাকি। কিন্তু পদ্মা সেতুর ব্যাপারে কী হলো? বিশ্বব্যাংক হঠকারীভাবে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের ভিত্তিহীন অভিযোগ করে। সেই কথিত দুর্নীতির প্রমাণ চাওয়ার পরও আমরা পাইনি। লেনদেন ব্যতীত অনুমান নির্ভরতার ওপর ধারণা করে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন থেকে সরে দাঁড়ায়। ’
পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসের প্রতীক, বাঙালির শতবর্ষে সাহসিকতার প্রতীক হয়ে থাকবে এটি। জাতিকে প্রথমবারের মতো আর্থিক সামর্থ্যের পরিচয়ও বহন করে এই পদ্মা সেতু।
অর্থনীতিবিদ এম খলীকুজ্জমান বলেন, ‘রাজনৈতিক সত্তা দিয়ে পদ্মা সেতু বিবেচনা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এটি তৈরি করে রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। এই সেতুর মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ও যোগাযোগব্যবস্থা আরো সমৃদ্ধ হবে, আমাদের অগ্রগতি আরো সুদৃঢ় ও ত্বরান্বিত করবে। ’
পানিসম্পদ ও জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন, ‘পদ্মা সেতু যখন নির্মাণ শুরু করি, তখন মাওয়াঘেঁষে ছিল। এখন কিছুটা সরে গেছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ ছিল কোনোভাবেই নদী সংকুচিত করা যাবে না। নদীভাঙন রোধের জন্য তীর রক্ষার কাজ করতে হয়। খুব কঠিন কাজ। ইলিশের যাতে অসুবিধা না হয় সে জন্য নির্মাণের সময় শব্দ নিয়ন্ত্রণ করেছি। মাছ যাতে যাওয়া-আসা করতে পারে, সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
এ জাতীয় আরো খবর..