×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৭-৩১
  • ৪৬ বার পঠিত
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর সংলাপ আজ রবিবার শেষ হওয়ার কথা। আজ শেষ দিনে অংশ নিচ্ছে ক্ষমতাসীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি।

এ ছাড়া দুটি দল এর আগে নির্ধারিত সময়ে সংলাপে অংশ না নিয়ে পরে সময় চেয়েছে। কিন্তু নির্বাচন কমিশন দল দুটিকে এখনো সময় দেয়নি।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র জানিয়েছে, দল দুটিকে সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহের দিকে সময় দেওয়া হতে পারে। নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ এ বিষয়ে গতকাল শনিবার কালের কণ্ঠকে বলেন, ওই দুটি দলকে সময় দেওয়ার বিষয়ে কমিশন এখনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।

kalerkanthoএদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গত ১৭ জুলাই থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত ইসির সঙ্গে সংলাপে যে ২৬টি দল অংশ নিয়েছে, তাদের মধ্যে সরকারি দলের বিপক্ষের অনেকেরই অনেক প্রস্তাব নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়নে কমিশনের কিছুই করার নেই। এসব প্রস্তাব বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান ও নির্বাচনী আইন সংশোধন এবং রাজনৈতিক ঐকমত্য ও সিদ্ধান্ত প্রয়োজন।

এসব প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের তফসিলের আগে জাতীয় সংসদ ভেঙে দেওয়া, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও জনসমর্থনহীন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল করা। আবার এর বিপরীতে ছিল ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দলগুলোর নিবন্ধন না দেওয়া, বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া। নির্বাচনের সময় সিইসির ‘সুপার প্রাইম মিনিস্টারের’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া, বর্তমান রাজনৈতিক সরকারের পরিবর্তে তদারকি সরকার, জাতীয় নির্বাচনকালীন সরকার বা জাতীয় পরিষদ গঠন, নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে নিয়োগ করা।

কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘এটা বাস্তবায়ন করলেও আমরা নিতে পারব তা মনে হয় না। ’

গত ২৫ জুলাই তিনি বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সংলাপে বলেন, ‘আমাদের যতটুকু ক্ষমতা আইনে দেওয়া হয়েছে, আমরা তা প্রয়োগের চেষ্টা করব। অনেক প্রস্তাব আমরা পেয়েছি। সংবিধান সংশোধনের প্রস্তাবও পেয়েছি। আমাদের ম্যান্ডেন্ট কিন্তু লিমিটেড। ’

ইসি সচিবালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কয়েকজন জানান, প্রায় পাঁচ বছর আগে কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের সংলাপে নিবন্ধিত সব রাজনৈতিক দল অংশ নিয়ে কমিশনের এখতিয়ারের বাইরে প্রায় অভিন্ন প্রস্তাব রাখে এবং তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ ছাড়া ওই নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত অনেক প্রস্তাবও লিখে রাখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারেনি নুরুল হুদা কমিশন।

এ সম্পর্কে তৎকালীন নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা আমাদের সঙ্গে সংলাপে আসা প্রস্তাবগুলো পুস্তকাকারে সরকারের এবং রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছিলাম। এর বেশি কিছু করার ছিল না। কারণ সংবিধানে যে ক্ষমতা আমাদের দেওয়া আছে তার বাইরে আমরা তো কিছু করতে পারি না। ’ এবারের সংলাপ নিয়ে আপনার মতামত কী—এ প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমাদের নিয়ে তো অনেক অভিযোগ আছে। আমরা গণতন্ত্র, নির্বাচনব্যবস্থা ধ্বংস করেছি—এসব বলা হয়। বর্তমান কমিশন হয়তো নতুন কিছু করবে। ’

কমিশনের এখতিয়ারবহির্ভূত প্রস্তাবগুলোর সম্পর্কে কী ব্যবস্থা নেবেন—এ প্রশ্নে নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশিদা সুলতানা গতকাল এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘সংলাপ শেষ হওয়ার পর কমিশনের সভায় এসব বিষয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যে প্রস্তাবগুলো পেয়েছি তার মধ্যে কোনগুলোর বাস্তবায়ন আমাদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে, আর কোনগুলো পড়ে না, তা পর্যালোচনা করে কতটুকু নিতে পারব, আর কতটুকু নিতে পারব না, সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ’

আরেক সাবেক নির্বাচন কমিশনার আবদুল মোবারক বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের এবং নির্বাচন কমিশনের জন্য যে আইন আছে, তা একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য যথেষ্ট। এসব আইন সংশোধনের, সংযোজনের আর কোনো প্রয়োজন নেই। সংলাপেরও প্রয়োজন নেই। সমস্যা হচ্ছে নির্বাচন কমিশনারদের সংখ্যা। সিইসিসহ মোট পাঁচজন নির্বাচন কমিশনার থাকার কারণে দ্রুত কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না। ’

৯টি দলের সংলাপ বর্জন

২৮ আগস্ট পর্যন্ত ইসির সঙ্গে সংলাপে নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে অংশ নেয় ২৬টি। ৯টি দল সংলাপ বর্জন করে। এ দলগুলো হচ্ছে বাসদ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ—বিএমএল, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, জেএসডি, এলডিপি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, সিপিবি, বিজেপি ও বিএনপি। দুটি দল বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ও জাতীয় পার্টি-জেপি নির্ধারিত সময়ে সংলাপে যোগ দিতে না পারায় পরে সময় চেয়েছে।

সংলাপে দলগুলোর প্রস্তাব

সংলাপে জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম) ১৩ দফা প্রস্তাব দেয়। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের সময় সিইসি ‘সুপার প্রাইম মিনিস্টার’ এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবেন। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের বদলির ক্ষমতা ইসির হাতে আনাসহ ১৬ দফা প্রস্তাব রাখে বাংলাদেশ কংগ্রেস। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ৯ দফা প্রস্তাব রাখে। এর মধ্যে রয়েছে নির্বাচনের সময় স্বরাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়সহ পাঁচটি মন্ত্রণালয় ইসির অধীনে আনা। বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে ‘জাতীয় পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাব রাখে। ইসলামী ঐক্যজোট নির্বাচনের সময় স্পর্শকাতর এলাকায় সেনা মোতায়েন ও ইভিএম সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়ানোর প্রস্তাব দেয়। বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস নির্বাচনের সময় সব নির্বাচনী এলাকায় সেনা মোতায়েনের এবং ইভিএম ব্যবহার না করার প্রস্তাব রাখে।

বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল বর্তমান সরকারের অধীনেই নির্বাচন ও ইভিএমের ব্যবহার করার প্রস্তাব রাখে। নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ চায় গণতন্ত্রী পার্টি। বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির প্রস্তাবের মধ্যে রয়েছে সব নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য সরকারের কাছে নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দিতে হবে; নির্বাচনের তিন মাস আগে থেকে এবং নির্বাচনের পরবর্তী কমপক্ষে এক মাস পর্যন্ত ম্যাজেস্ট্রেসি ক্ষমতা দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েনের ব্যবস্থা নিতে সরকারকে অনুরোধ জানাতে হবে; বিভিন্ন দিনে বা এক বিভাগে এক দিন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের আয়োজন এবং নির্বাচন শেষে এক দিনে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করতে হবে; ‘না’ ভোটের বিধান চালু করতে হবে। গণফ্রন্ট জাতীয় সংসদের আসন সংখ্যা ন্যূনতম ৩৫০ থেকে ৪৫০ করার প্রস্তাব রাখে।

জাসদ নির্বাচনকালে জনপ্রশাসনের কাজে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটদের অধীনে ব্যবহার, সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অনুযায়ী যথাসময়ে নির্বাচন, নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীদের ১ শতাংশ ভোটারের সমর্থনসূচক স্বাক্ষরের বিষয়টি বিবেচনা, নির্বাচনে ধর্মের ব্যবহার কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব রাখে। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ইভিএমে ভোটগ্রহণের বিপক্ষে মত দেয়। এ ছাড়া নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সঙ্গে সেনাবাহিনীকে ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতা প্রদান, নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের প্রস্তাব দেয়। ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ সংসদ নির্বাচন তিন দিনে করার প্রস্তাব রাখে। দলটির অন্য প্রস্তাবগুলোর মধ্যে রয়েছে সংসদ নির্বাচনে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ না দেওয়া। বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনের ক্ষেত্রে স্বাধীনতাবিরোধী ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দলগুলোর নিবন্ধন না দেওয়ার জন্য প্রস্তাব রাখে। এ ছাড়া বর্তমানে সংবিধানের বিধান অনুযায়ী সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কোনো বিকল্প নেই বলেও মত দেয় দলটি। বাংলাদেশ মুসলিম লীগ জানায়, তারা সংসদ নির্বাচনে ইভিএমের ব্যবহার চায় না। ‘না’ ভোটের ব্যবস্থাও ফিরিয়ে আনতে বলে দলটি।

বিকল্পধারার পক্ষ থেকে নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইভিএম ব্যবহার করাসহ সাত দফা প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। এনপিপি নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রগুলোতে সিসি ক্যামেরা বসানো ও নির্বাচনে প্রার্থীদের জামানত ১০ টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং তফসিল ঘোষণার পর কোনো রাজনৈতিক মামলা না দেওয়ার প্রস্তাব রাখে। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ নির্বাচনের সময় নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানায়। এ ছাড়া দাবি করে, ধর্মীয় মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাহীন ও জনসমর্থনহীন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন বাতিল, প্রতীক বরাদ্দের পর থেকে নির্বাচন-পরবর্তী এক সপ্তাহ পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেসি ক্ষমতাসহ সেনাবাহিনী মোতায়েন এবং ইভিএমের পরিবর্তে ব্যালট পেপারে ভোটগ্রহণ।

জাকের পার্টির প্রস্তাবে বলা হয়, ইভিএম প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা প্রশংসনীয়। কিন্তু ইভিএম পুরো নিশ্ছিদ্র বা নিরাপদ না। নির্বাচনকে বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখতে ব্লকচেইন প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ই-ভোটিং প্রক্রিয়ায় ঘরে বসে ভোট প্রদানের ব্যবস্থা এখনই গ্রহণ করা উচিত। কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ প্রার্থীদের হলফনামায় মামলার তথ্য নেওয়া বন্ধ করা এবং দল নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করার প্রস্তাব রাখে। গণফোরাম বিচারিক ক্ষমতাসহ সশস্ত্র বাহিনী মোতায়েন, তাদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্তকরণ ও নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের প্রস্তাব রাখে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (বাংলাদেশ ন্যাপ) তফসিল ঘোষণার পর সংসদ বিলুপ্তির দাবি জানায়। এ ছাড়া দলটি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী থেকে রিটার্নিং অফিসার নিয়োগের প্রস্তাব দেয়। এ ছাড়া ইভিএম ব্যবহার না করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদব্যবস্থা চালু ও সংসদের আসন সংখ্যা বৃদ্ধিসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব দেয় দলটি। তরিকত ফেডারেশনের প্রস্তাব—নির্বাচন দুই বা তিন ধাপে করার পাশাপাশি জাতীয় সংসদের অর্ধেক আসনের নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করতে হবে। ইসলামী ঐক্যজোট নির্বাচনকালীন সরকারের আকার সীমিত করা এবং আস্থা অর্জন করে ইভিএমের ব্যবহারের সুপারিশ রাখে। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ তদারকি সরকার বা অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন, দল নিবন্ধনের শর্ত সহজ করা, নির্বাচনী ব্যয় মাত্র পাঁচ লাখ টাকা নির্ধারণ ও ‘না’ ভোট চালুর প্রস্তাব রাখে। বিএনএফের পক্ষে বলা হয় নির্বাচনে নির্বাচন কমিশনকে সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। সংবিধান অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনকে নির্বাহী বিভাগ সহায়তা করবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat