দূরত্ব কমবে। জ্বালানি খরচ কমবে। ফেরি ও সেতুর টোলের পার্থক্যও খুব বেশি হয়নি। তবু পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচলকারী যানবাহন, বিশেষ করে বাসের ভাড়া বাড়ানোর তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে।
গতকাল মঙ্গলবার পদ্মা সেতুর টোল চূড়ান্ত করে প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
আগামী ২৪ মে এ বিষয়ে সেতু মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পরিবহন মালিকরা বসতে যাচ্ছেন। তাতে টোলসহ ভাড়া সমন্বয়ের আলোচনা হওয়ার কথা। তবে পরিবহন মালিকরা সেখানে ভাড়া বাড়ানো পক্ষেই যুক্তি তুলে ধরবেন।
গতকাল জারি করা প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী দেখা যায়, যাত্রীবাহী পরিবহনের ক্ষেত্রে ফেরির তুলনায় সেতুতে টোল কিছুটা বেশি। মোটরসাইকেলসহ ব্যক্তিগত যানবাহনের টোলও ফেরির তুলনায় সামান্য বেড়েছে। তবে পণ্যবাহী যানের ক্ষেত্রে টোল অনেক বেশি ধরা হয়েছে।
তবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পদ্মা সেতুর যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে, তা এই পথের শেষ টোল নয়। পদ্মা সেতুর সঙ্গে মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের টোলও দিতে হবে। এতে এই পথে যাতায়াতকারীদের সড়ক ও সেতুর দুটি টোল দিতে হবে। তাই পদ্মা সেতু ও ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ের টোল সাধারণ মানুষের জন্য বোঝা হয়ে যাচ্ছে কি না তা দেখা উচিত।
পদ্মা সেতু তৈরি সরকারের নিজস্ব অর্থায়নে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই টোলের মাধ্যমে ৩৫ বছরের মধ্যে সেতুর ব্যয় তুলে আনতে চায়। পদ্মা রেল সেতুর টোলের ক্ষেত্রেও ৩৫ বছরে খরচ আদায়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সেতু টোল বনাম ফেরির ভাড়া
পদ্মা সেতুর টোল হার মোটর সাইকেল ১০০ টাকা, কার ও জিপ ৭৫০ টাকা, পিকআপ এক হাজার ২০০ টাকা, মাইক্রোবাস এক হাজার ৩০০ টাকা, ছোট বাস (৩১ আসন বা এর কম) এক হাজার ৪০০ টাকা, মাঝারি বাস (৩২ আসনের বেশি) দুই হাজার টাকা এবং বড় বাস (তিন এক্সেল) দুই হাজার ৪০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ছোট ট্রাক (পাঁচ টন পর্যন্ত) এক হাজার ৬০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (পাঁচ থেকে আট টন পর্যন্ত) দুই হাজার ১০০ টাকা, মাঝারি ট্রাক (আট থেকে ১১ টন) দুই হাজার ৮০০ টাকা, ট্রাক (তিন এক্সেল পর্যন্ত) পাঁচ হাজার ৫০০ টাকা, ট্রেইলার (চার এক্সেল পর্যন্ত) ছয় হাজার টাকা ধরা হয়েছে। আর চার এক্সেলের বেশি ট্রেইলারের ক্ষেত্রে প্রতি এক্সেলে দেড় হাজার টাকা যোগ হবে।
বর্তমানে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার যানবাহন যাতায়াত করে মুন্সীগঞ্জের শিমুলিয়া, মাঝিকান্দি ও বাংলাবাজার ফেরিঘাট দিয়ে। এখানে ফেরিভাড়া মোটরসাইকেল ৭০ টাকা, কার বা ছোট জিপ ৫০০ টাকা, মাইক্রোবাস ৮৬০ টাকা, বড় জিপ ৮০০ টাকা, পিকআপ ৯৮০ টাকা, মিনিবাস এক হাজার ২০০ টাকা, মাঝারি বাস এক হাজার ৭১০ টাকা, বড় বাস দুই হাজার ৩১০ টাকা, ট্রাক (তিন থেকে পাঁচ টন) এক হাজার ৮০ টাকা, ট্রাক (আট টনের ওপরে) এক হাজার ৮৫০ টাকা এবং ১০ চাকার পণ্যবাহী ট্রাক তিন হাজার ৯৪০ টাকা।
যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক শামছুল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি মনে করি, পদ্মা সেতুর টোলের হার ঠিক আছে। এতে মানুষ যেমন সুবিধা পাবে, তেমনি পচনশীল পণ্য পরিবহনেও ঝুঁকি কমবে। ’ তিনি আরো বলেন, বাসের ভাড়া খুব একটা বাড়বে না, যদি বিআরটিএ সঠিকভাবে বাস মালিকদের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে। কিলোমিটারপ্রতি ভাড়াটা শক্তভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
এই বিশেষজ্ঞ জানান, ফেরিঘাটে টোলের বাইরে অদৃশ্য অনেক খরচ আছে। যেমন—লম্বা সময় ঘাটে আটকে থাকলে পরিবহনকর্মীদের একাধিক বেলা খাবারের খরচ হয়। আগে ফেরিতে ওঠার জন্য অবৈধভাবে অর্থ খরচ করতে হয়। সেতুতে তা হবে না।
দূরত্ব কমবে, বাঁচবে জ্বালানির খরচ
ঢাকা থেকে সড়কপথে খুলনার দূরত্ব প্রায় ২৫৫ কিলোমিটার। কিন্তু পদ্মা সেতু দিয়ে যাতায়াত করলে দূরত্ব কমে দাঁড়াবে ১৯০ কিলোমিটার। ৬৫ কিলোমিটার পথ কমে আসবে। এতে জ্বালানি খরচ কমবে।
পরিবহনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সাধারণত বেশির ভাগ বাস ডিজেলে চলে। এক লিটার ডিজেলের দাম ৮৫ টাকা। ৬৫ কিলোমিটার পথ কমে যাওয়ায় ঢাকা-খুলনা বাসে জ্বালানির খরচ কমবে প্রায় এক হাজার ৭৮৫ টাকা। ট্রাকে জ্বালানির খরচ কমবে এক হাজার ১৭০ টাকা, ট্রেইলারে দুই হাজার ৭৬৩ টাকা, মাইক্রোবাস ও ব্যক্তিগত গাড়িতে ৫৭৯ টাকা এবং মোটরসাইকেলে জ্বালানির খরচ কমবে ১৩৪ টাকা।
পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-যশোরের দূরত্ব বর্তমানের ২১২ কিলোমিটার থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার কমে যাবে। এতে বাসে জ্বালানি বাঁচবে প্রায় ১৭ লিটার। তবু যশোরের বাস মালিকরা বলছেন, তাঁরা ফেরি পারাপারে বাস চালাবেন। এতে তাঁদের যাত্রী বেশি হবে। ঢাকা-যশোর রুটের বাস জয় পরিবহনের মালিক আজিজুল আলম মিন্টু বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ গাড়ি দৌলতদিয়া হয়ে যাবে। কারণ আমাদের বর্তমান রুটে যাত্রী বেশি। ’
তবে পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-বরিশাল যাতায়াতে দূরত্ব সাত কিলোমিটার বাড়বে। এতে বাসের জ্বালানি খরচ বাড়বে প্রায় ১৮০ টাকা। বরিশাল জেলা বাস মালিক গ্রুপের সভাপতি কিশোর কুমার কালের কণ্ঠকে বলেন, এই রুটে এখন ফেরির ভাড়া দুই হাজার ৬০০ টাকা। সেতুর টোল তার চেয়ে ২০০ টাকা কম হচ্ছে। এখন জনপ্রতি ভাড়া ৬৫০ টাকা। সরকার হয়তো নতুন ভাড়া নির্ধারণ করে দেবে। তবে মালিকরা চাচ্ছেন ভাড়া বাড়ুক, যাতে পরিবহন ব্যবসা চালু থাকে।
জ্বালানির খরচ কমলেও বাড়বে বাসের ভাড়া
যাত্রী ও পণ্যবাহী যানের জ্বালানির খরচ কমলেও ভাড়া বৃদ্ধির আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন পরিবহন মালিকরা। তাঁদের আকাঙ্ক্ষার প্রতি ইতিবাচক মনোভাব দেখাচ্ছে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষও। বর্তমানে ঢাকা-খুলনা পথে যেসব নন-এসি বাস ফেরি হয়ে চলাচল করে, সেগুলোর ভাড়া ৭০০ টাকা। আর যেসব বাস যাত্রীদের লঞ্চে পারাপার করে থাকে সেসব বাসের ভাড়া ৬০০ টাকা। বিআরটিএ দূরপাল্লার বাসের ভাড়া প্রতি কিলোমিটার এক টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করেছে। সেই হিসাবে এই পথের ভাড়া হওয়ার কথা ৪৫৯ টাকা।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘পদ্মা সেতুর টোল নিয়ে এখনই কোনো মন্তব্য করব না। আগামী ২৪ তারিখ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আমাদের বৈঠক আছে। বৈঠকের আগে কথা বলা ঠিক হবে না। ’
বাসের ক্ষেত্রে সেতুতে টোল বেশি ধরা হয়েছে কি না জানতে চাইলে এনায়েত উল্যাহ বলেন, ‘টোলের সঙ্গে ভাড়ার একটি সম্পর্ক আছে। টোল তো ভাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। এখানেও বিআরটিএকে (বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ) ভাড়া বাড়িয়ে সমন্বয় করে দিতে হবে। ’
বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান রমেশ চন্দ্র ঘোষ কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশে চলাচল করা বেশির ভাগ বাসই হচ্ছে মাঝারি আকৃতির। ফেরির ভাড়ার সঙ্গে সেতুর টোলের খুব বেশি পার্থক্য নেই। তাই বাসের ভাড়া না বাড়ালেও চলে। তবে পরিস্থিতি দেখে হিসাব করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, টোলের টাকা যাত্রীদের ভাড়ার সঙ্গে সমন্বয় করা হয়, এটাই নিয়ম। এ ক্ষেত্রেও তাই হবে। একটি বাসের জন্য যে টোল নির্ধারণ করা হয়েছে সেটা মোট যাত্রী দিয়ে ভাগ করে ভাড়ার সঙ্গে যুক্ত করা হবে।
দূরত্ব কমে যাওয়া এবং জ্বালানি খরচ কম হওয়ায় বাসের ভাড়া কমা উচিত কি না জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান বলেন, ‘প্রতি কিলোমিটার একটা ভাড়া নির্ধারণ করা আছে। কিলোমিটার দিয়ে হিসাব করে ভাড়াটা নির্ধারণ করা হবে। নির্ধারিত সেই ভাড়ার সঙ্গে টোলের টাকাটা আবার যুক্ত করা হবে। এভাবেই সেতু ব্যবহারকারী বাসের ভাড়া ঠিক করা হবে। ’
তবে বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী মনে করেন, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক দুই থেকে চার লেন করার সময় বাঁকগুলো সোজা করায় ৪০ কিলোমিটার পথ কমে গেছে। কিন্তু ওই পথে বাসভাড়া এক টাকাও কমানো হয়নি। এখানে পথের দূরত্ব কমলেও ভাড়া কমবে না। উল্টো ভাড়া বাড়ানো হবে। এখন কত বাড়ে সেটাই দেখার বিষয়। যদি ভাড়া বেশি হয় তাহলে সব মানুষ পদ্মা সেতু ব্যবহার করতে পারবে না।
প্রভাব ফেলবে পণ্যের দামে
ফেরির তুলনায় সেতুতে পণ্যবাহী যানের টোল অনেক বেশি। তাই পণ্যবাহী যানের ভাড়া বাড়লে সেটা সরাসরি পণ্যের ওপর পড়বে এবং শেষ পর্যন্ত তা সাধারণ ভোক্তার পকেট থেকে যাবে।
বাংলাদেশ ট্রাক কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হোসেন মো. মজুমদার বলেন, ‘বাসের ক্ষেত্রে টোল হার ফেরির সঙ্গে স্বাভাবিক থাকলেও ট্রাকের বেলায় সেটা নেই। স্বাভাবিকভাবে ট্রাকের ভাড়া বাড়বে। এতে পণ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। আমরা ভাড়া বাড়াতে চাই না। সরকারের কাছে দাবি জানাব টোলের হার পুনর্বিবেচনা করার জন্য।
এ জাতীয় আরো খবর..