‘আচ্ছা, সাকিব কি জানত না ওর বেটউইনারের মতো প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করা ঠিক হবে না?’
কাল রাতে প্রশ্নটা যেন নিজেকেই নিজে করলেন বিসিবির এক কর্মকর্তা। মুঠোফোনের এ প্রান্ত থেকে কিছু শোনার অপেক্ষা না করে উত্তরটাও নিজেই দিয়ে দিলেন, ‘অবশ্যই জানত। ও তো না জেনে, না বুঝে কিছু করার ছেলে নয়!’
এমন মন্তব্যে সন্দেহের একটা অব্যক্ত প্রকাশ থাকে। তার মানে বিতর্ক তৈরি হবে জেনেও সাকিব চুক্তি করেছেন! কিন্তু তিনি যদি জানতেনই যে বেটিং–সংশ্লিষ্ট একটা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করলে প্রশ্নের সম্মুখীন হবেন, তাহলে সেটা কেন করলেন?
কেন করলেন, তা গত দু-তিন দিনে সাকিবের সঙ্গে যোগাযোগেই বিসিবি মোটামুটি ধরতে পারছে। কারণ, বিষয়টি আলোচনায় আসার পরও নাকি সাকিব বিসিবিকে বোঝাতে চেয়েছেন, বেটউইনার নিউজের সঙ্গে তাঁর চুক্তি আইনগতভাবে এবং নীতিগতভাবেও অনুচিত কিছু নয়। কারণ, বেটউইনার নিউজ একটি সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইট মাত্র। এর সঙ্গে বেটিং বা জুয়ার সম্পর্ক নেই। কাজেই এই চুক্তি করে দেশের আইন বা বিসিবির আচরণবিধি—কোনোটাই তিনি ভঙ্গ করেননি।
হতে পারে সাকিবের এজেন্টও তাঁকে এভাবেই বুঝিয়েছেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক ও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের অলিগলি তো কম চেনেন না সাকিব। বুঝে হোক, না বুঝে হোক, নিষিদ্ধ পথেও তো চলে গিয়েছিলেন একবার। কাজেই কোন সঙ্গে সর্বনাশ, সেটি তিনি বোঝেন না বললে রামগড়ুরের ছানাও হেসে দিতে পারে। এজেন্টের দেখানো পথ যে কাঁটা বিছানো, সেটি জেনেই সাকিব সে পথে পা রেখেছেন বলে অন্তত বিসিবির ধারণা। ‘বেটিং’ যদি না–ও হয়, সাকিব হয়তো এটাকে ‘ব্যাটিং’ ভেবেছেন। ব্যাটিংয়ের মতোই খেলে ফেলবেন একটা ঝুঁকিপূর্ণ শট। ঠিকঠাক লেগে গেলেই তো ছক্কা!
তবে আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে না সাকিবের সেই ‘ঝুঁকিপূর্ণ শট’ বাউন্ডারি অতিক্রম করবে। সেখানে ক্যাচ নিতে বিসিবির কড়া প্রহরা। বিসিবি সভাপতি আগেই কঠিন কণ্ঠে বলেছেন, এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাকিবের চুক্তি তাঁরা মানবেন না। গত দুই দিনে সেই সিদ্ধান্ত আরও পোক্ত হয়ে এখন এ পর্যায়ে যে সাকিবের ই–মেইল ঠিকানায় একটি কড়া চিঠি এই গেল বলে। সেখানে স্পষ্ট লেখা থাকবে, বেটউইনার নিউজের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে ঘরের ছেলে ঘরে ফিরে আসো।
কিন্তু সাকিব যদি তাতে সাড়া না দেন, তখন কী হবে? তিনি তো নাকি এরই মধ্যে বিসিবিকে বোঝানোর চেষ্টা শুরু করেছেন, তিনি যে প্রতিষ্ঠানের পণ্যদূত হয়েছেন, সেটি বেটিংয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়। বেটউইনার নিউজের ওয়েবসাইটে ঢুকেও প্রথমেই লাল হরফে লেখা ঘোষণাটি চোখে পড়ল কাল। এটি কেবলই একটি খেলাধুলার সংবাদ ওয়েবসাইট। কেউ যদি বেটিংয়ের উদ্দেশে তাতে ঢুকে থাকেন, তাঁর আশায় গুড়ে বালি। তারা যেন অনতিবিলম্বে সাইট ত্যাগ করেন।
সমস্যা এখানেই। একটি সংবাদভিত্তিক ওয়েবসাইটকে ঘোষণা দিয়ে বলতে হচ্ছে, ‘আমরা কিন্তু বেটিং-ফেটিং করি না।’ কেন? কারণ, তাদের মূল ওয়েবসাইট বেটউইনারের ব্র্যান্ড পরিচয়ই হলো বেটিং ওয়েবসাইট হিসেবে, যার মাধ্যমে বাজি ধরা যায় এবং অনলাইন ক্যাসিনো খেলা যায়। বাংলাদেশের আইনগত ও সামাজিক বাস্তবতায় দুটোই নিষিদ্ধের পর্যায়ে। বেটউইনার নিউজ সেই ওয়েবসাইটের ভগ্নিসাইট বলেই সংশয়ের বাতাবরণ। তাদের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে সাকিব আবারও বিতর্কের কেন্দ্রে। বিসিবি চায় তিনি এখান থেকে সরে আসুন।
কিন্তু চুক্তি হয়ে যাওয়ার পর আইনগতভাবে সাকিবের তা থেকে সরে আসার সুযোগ রয়েছে কি না, সেটি দেখার বিষয়। সাকিব যদি কাগজপত্রে দেখাতে পারেন যে বেটউইনার নিউজের সঙ্গে তাঁর চুক্তি দেশের আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয় বা এতে বিসিবির আচরণবিধিও ভঙ্গ হয়নি, তাহলে কি বিসিবি তাঁকে বাধ্য করতে পারবে চুক্তি থেকে সরে আসতে? আর সরে এলে যদি সাকিবকে উল্টো বেটউইনার নিউজের সঙ্গে চুক্তির শর্ত ভঙ্গের অভিযোগে পড়তে হয়, সেই ঝুঁকি কি তিনি নেবেন?
এ প্রশ্নে বিসিবিও একটু দ্বিধান্বিত। বেটউইনার নিউজের সঙ্গে সাকিবের চুক্তির আইনগত দিকগুলো তাই খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সমান্তরালে বিসিবি এ স্লোগানও তুলছে, আইনকানুন যা–ই থাকুক, নীতিগতভাবেই এ রকম প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা সাকিবের ঠিক হয়নি। দেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আইকন তিনি। ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক আকাশে বাংলাদেশের উজ্জ্বলতম নক্ষত্র। তাঁর কত ভক্ত, কত অনুসারী। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পথপ্রদর্শক হয়ে সাকিব তাদের কী দেখাচ্ছেন? কী উদাহরণ রেখে যাচ্ছেন? অর্থই কি সব!
সমস্যা হলো, আইন এক জিনিস আর নীতিকথা আরেক জিনিস। এখানে যদি আইনের ফাঁক থেকে থাকে, সাকিবকে নৈতিকতার শৃঙ্খলে আটকানো কঠিন হবে বিসিবির জন্যও। কারণটা তারাও জানে। সাকিব না জেনে কিছু করার লোক নন। সাকিব কাঁটাযুক্ত পথে পা বাড়িয়েছেন পথে কাঁটা আছে জেনেই। ঝুঁকিপূর্ণ শটটা খেলেছেন ক্যাচের কথা মাথায় রেখেই।
এখন দেখা যাক বাউন্ডারির প্রহরী বিসিবি সেই ক্যাচ নেয় কি না। সামনে এশিয়া কাপ টি-টোয়েন্টি এবং টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। জোরালো গুঞ্জন, সাকিব দুটোতেই বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেবেন। কিন্তু তার আগে বেটউইনারের ব্যাট হাতে তিনি যে বিতর্কের খানাখন্দ তৈরি করলেন, সেটি ভরাট হওয়া প্রয়োজন। সাকিব ভরাট করলে তো হলোই, নয়তো দায়িত্বটা বিসিবির কাঁধেই বর্তাবে।
সাকিবের তারকাদ্যুতিতে যদি তাদের চোখও ঝলসে যায়, তাহলে অবশ্য ভিন্ন কথা। বেটউইনারের বাজিতে তখন হেরে যাবে বাংলাদেশের ক্রিকেট। বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় আইকন বলেই যে সাকিবের ব্যাপারে কঠোর হতে গেলে অদৃশ্য হাত কলার টেনে ধরে বিসিবির!
এ জাতীয় আরো খবর..