৫৫ বছর বয়সী বেলায়েত শেখের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) পড়ার কাঙ্ক্ষিত সেই স্বপ্নপূরণ হলো না। ঢাবির ২০২১-২০২২ শিক্ষাবর্ষে সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলেও তিনি উত্তীর্ণ হতে পারেননি। স্বপ্ন ভেঙে গেলেও হার মানতে রাজি নন বেলায়েত শেখ। তিনি লড়বেন আসন্ন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি), রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ও জাহাঙ্গীনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ভর্তিযুদ্ধেও।
মঙ্গলবার (৫ জুলাই) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদভুক্ত ‘ঘ’ ইউনিটের ফল প্রকাশিত হয়। ঘোষিত ফলাফলে বেলায়েত শেখ অকৃতকার্য হয়েছেন। এতে বেলায়েতের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।
তবুও থেমে যাবেন না বেলায়েত শেখ। আগামী ২৬ জুলাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ‘এ’ ইউনিট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ‘সি’ ইউনিট ও ২২ আগস্ট চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) ‘ডি’ ইউনিটে অনুষ্ঠিতব্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেবেন তিনি। ইতোমধ্যে রাবি ও জাবির প্রবেশপত্র হাতে পেয়েছেন বেলায়েত শেখ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফলাফল জেনেছেন বেলায়েত শেখ এতে তিনি থেমে বিষন্ন মন নিয়ে বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
মঙ্গলবার বিকালে কথা হয় বেলায়েত শেখের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে জানান, ঢাবির ভর্তি যুদ্ধে হেরে বিচলিত হয়ে পড়লে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষায় এর প্রভাব পড়বে। তাই তিনি ঢাবিতে খসে পরার কথা না ভেবে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য বিভিন্ন সাজেশন ও গাইড বই পড়ছেন। এ সময় কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমি তুলনামূলক ভালো পরীক্ষা দিয়েছিলাম। তবুও পরীক্ষার ফল খারাপ এসেছে। আমার স্বপ্ন, আমার মায়ের স্বপ্ন ও আমার পরিবারের সদস্যদের স্বপ্ন ছিল আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব। কিন্তু সেই স্বপ্ন আমার পূরণ হলো না।স্বপ্ন পূরণ না হলেও পড়ালেখা চালিয়ে যেতে চান বেলায়েত শেখ।
তিনি বলেন, আমার স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। কিন্তু সেই স্বপ্ন তো আমার পূরণ হলো না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও আমি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ইউনিট, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সি’ ইউনিট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডি’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য আবেদন করেছি। আমি সেই পরীক্ষায় অংশ নিতে প্রস্তুতি নিচ্ছি। রাতদিন বিভিন্ন ভর্তি গাইড ও সাজেশনের সহযোগিতা নিচ্ছি। এছাড়াও যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছেন তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছি- কেমন প্রশ্ন হতে পারে সেগুলো জানছি। আমাকে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ফোন করে পরামর্শ দিচ্ছেন। আমি এতে বেশ উৎসাহ পাচ্ছি। স্বপ্ন পূরণে আপনারা আমার জন্য দোয়া করবেন, আমি যেন যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারি।
উল্লেখ্য, গাজীপুরের শ্রীপুর পৌরসভার কেওয়া পশ্চিমখণ্ড গ্রামের মাওনা চৌরাস্তা এলাকার মৃত হাসান আলী শেখ ও জয়গন বিবি দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে দ্বিতীয় সন্তান বেলায়েত শেখ। তিনি দৈনিক করতোয়া পত্রিকার শ্রীপুর প্রতিনিধি। ১৯৬৮ সালের ৭ সেপ্টেম্বরে তার জন্ম। ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি ছিল আগ্রহ। প্রবল আগ্রহ থাকলেও দারিদ্র্যের কারণে সময় মতো তা হয়ে ওঠেনি।
১৯৮৩ সালে নবম শ্রেণিতে পড়াশোনাকালে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েন তার বাবা হাসান আলী। বাবার চিকিৎসার টাকা জোগাড় করতেই পরিবারের সকলে হিমশিম খাচ্ছিলেন। পরবর্তীতে বন্ধ হয়ে যায় তার লেখাপড়া। তখন বেলায়েত কাঁধে তুলে নেন পুরো সংসারের দায়িত্ব।
পরবর্তীতে ছয় মাসের প্রশিক্ষণ নিয়ে বেলায়েত মোটর গাড়ির ওয়ার্কশপে কাজ শুরু করেন। দিনমজুরি ছাড়াও চা বিক্রির কাজও করেছেন তিনি। এসব করে যা উপার্জন হতো তা দিয়েই কোনো মতো চলে যেত সংসার। সঙ্গে ভাই-বোনদের পড়াশোনার দায়িত্ব পড়ে তার কাঁধে। অভাবের মাঝে ভাই-বোনদের উচ্চশিক্ষা দিতে না পেরে সন্তানদের নিয়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন বুনেন তিনি। কিন্তু সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি তিন সন্তানের জনক বেলায়েত শেখের।
ভাই-বোন ও সন্তানদের অপ্রাপ্তি নিজের কাঁধে তুলে নেন বেলায়েত। শুরু করেন আবার পড়াশোনা। ২০১৭ শিক্ষাবর্ষে ঢাকার বাসাবো দারুল ইসলাম আলিম মাদ্রাসায় (ভোকেশনাল) নবম শ্রেণিতে আবার রেজিস্ট্রেশন করেন। সেখান থেকেই নিয়মিত ছাত্র হিসেবে তিনি ২০১৯ সালে জিপিএ ৪.৫৮ পেয়ে দাখিল (ভোকেশনাল) পাশ করেন। পরে ভর্তি হন মহানগর টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে। সেখানে দুই বছর পড়ে ২০২১ সালে উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি-ভোকেশনাল) পরীক্ষা দেন। যার ফল প্রকাশ হয় এ বছর। এই পরীক্ষায় তিনি জিপিএ ৪.৪৩ নিয়ে পাশ করেন।
বেলায়েতের ছোট ছেলে সাদেক শেখ জীবন বলে, বাবা যখন ৯ম শ্রেণিতে পড়েন তখন আমি ৮ম শ্রেণিতে। বাবা যখন এইচএসসি পাশ করেন তখন আমি এসএসসি পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করি। উভয় পরীক্ষায় আমার চেয়েও বাবার জিপিএ বেশি। বাবা সংসারের অন্যান্য কাজ করেও লেখাপড়া করেন। আমরা রাতে যখন ঘুমিয়ে যাই, তখন তিনি রাত জেগে লেখাপড়া করেন।
বেলায়েতের স্ত্রী সখিনা আক্তার বলেন, আমার স্বামী ঢাবির ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে অনেক টেনশনে ছিলেন। রাতে আমরা শুয়ে পড়লে আমাদের যাতে কোনো সমস্যা না হয় তার জন্য তিনি বাড়ির সামনে তার অফিস কক্ষে বসে গভীর রাত পর্যন্ত লেখাপড়া করেন।
বেলায়েত শেখ বলেন, বুড়ো বয়সে আমার লেখাপড়া নিয়ে এলাকার অনেকের তিরস্কার ও নানা কটূক্তি শুনতে হয়েছে। এসব এড়াতেই আমি এলাকার প্রতিষ্ঠানে না পড়ে ঢাকায় ভর্তি হই। আমার কাছের মানুষজনও আমাকে নিয়ে হাসি-ঠাট্টা করত। তবে একটা সময় গিয়ে সেটা ঠিক হয়ে যায়।
তিনি বলেন, যাদের সঙ্গে ক্লাস করেছি, তাদের কাছ থেকে খারাপ কোনো অভিজ্ঞতার শিকার হইনি। আমার সঙ্গে যেসব মেয়ে ক্লাস করে, তারা আমাকে ‘আঙ্কেল’ ডাকে। আর আমি তাদের ‘আম্মু’ ডাকি। এক ছেলে আমাকে ‘বুড়া’ ডেকেছিল। পরে তাকে আমি বলেছি- এই আমি কি বুড়া হইছি? আমাকে ‘দাদা ভাই’ না হয় ‘বড় ভাই’ বা ‘আঙ্কেল’ ডাকবা। এটা নিয়ে তারা বেশ হাসাহাসি করত।
বেলায়েত বলেন, আমার কাছে নিজেকে বয়স্ক লাগে না, ইয়ংয়ের মতোই লাগে। কিছু চুল পেকে গেছে। এগুলো কালি দিয়ে রাখি। কারণ কালি দিয়ে না রাখলে এগুলোর জন্য নিজেকে বয়স্ক মনে হয়। আর তখন মনটা দুর্বল হয়ে যায়।
এ জাতীয় আরো খবর..