মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের খাঁচার সামনে বিস্ময় দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে ছিলেন বকুল বিশ্বাস। তাঁর চেহারায় লেগে ছিল বিজয়ের হাসি। গত মঙ্গলবার দুপুরে এমন দৃশ্য দেখে কাছে এগিয়ে যেতেই বকুল জানালেন, চিড়িয়াখানার জীবজন্তু দেখতে ছয় বছরের নাতনি ও স্ত্রীকে নিয়ে সোমবার রাতে পাবনা থেকে রওনা দিয়েছিলেন তিনি। রাত ৩টায় পৌঁছে যান রাজধানীর গাবতলী বাসস্ট্যান্ডে।
সেখান থেকে ভোরে চিড়িয়াখানার গেটে এসে অপেক্ষায় ছিলেন। সকাল ৯টায় প্রবেশদ্বার খুললে ভেতরে প্রবেশ করেন তিনি। শৈশব থেকেই তাঁর চিড়িয়াখানা দেখার ইচ্ছা ছিল। অবশেষে এই মধ্যবয়সে সেই ইচ্ছা পূরণ হলো।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের তথ্য মতে, প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১৫ হাজার দর্শক ঘুরতে আসে মিরপুর জাতীয় চিড়িয়াখানায়। সেই হিসাবে বছরে অর্ধকোটির বেশি মানুষ ঘুরতে আসে সেখানে। তবে একটু বিনোদনের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসা দর্শনার্থীরা বিভিন্নভাবে প্রতারিত হচ্ছে চিড়িয়াখানার ইজারাদারদের কাছে। বিচিত্র উপায়ে এই ইজারাদাররা দর্শনার্থীদের কাছ থেকে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চিড়িয়াখানায় প্রবেশের আগে বহিঃ পার্কিং থেকে শুরু ইজারাদারদের দৌরাত্ম্য। চলতি অর্থবছরে ৬৫ লাখ টাকায় এই পার্কিংয়ের ইজারা দেওয়া হয় মেসার্স আদিবা এন্টারপ্রাইজ নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে। গত ২৩ জুলাই দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর দর্শনার্থীদের কাছ থেকে কৌশলে বেশি অর্থ আদায় করছে প্রতিষ্ঠানটি। একটি মোটরসাইকেল পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত ফি ১০ টাকা। কিন্তু আদায় করা হচ্ছে ৪০ টাকা। প্রাইভেট কার পার্কিয়ের জন্য ১০০ টাকা এবং মাইক্রোবাস পার্কিংয়ের জন্য আদায় করা হচ্ছে ১২০ টাকা। নেওয়ার কথা ৫০ ও ৬০ টাকা। কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠানটি ফি আদায়ের রসিদে টাকার পরিমাণ উল্লেখ করেনি। আবার পার্কিং সুবিধা না নিলেও ইজারাদারদের লোকজন সেখান দিয়ে চলাচল করা গাড়িচালকের কাছ থেকে জোর করে ২০ টাকা করে আদায় করছে। রশিদ নামের এক প্রাইভেট কার চালক বলেন, 'গাড়ির মালিকের আত্মীয়দের নিয়ে চিড়িখানায় এসেছিলাম। ফটকে তাদের নামিয়ে দিয়ে ফেরার পথে ব্যারিকেড দিয়ে ২০ টাকা আদায় করে নিল কয়েকজন। '
রশিদের কথার সত্যতা পাওয়া গেল পার্কিংয়ের সামনের সড়কে গিয়ে। শুধু প্রাইভেট কার নয়, চিড়িয়াখানার ফটকের সামনে আসা রিকশা, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ সব ধরনের যানবাহন থেকে জোর করে ২০ টাকা আদায় করতে দেখা গেছে। জোর করে টাকা আদায়ের ভিডিও ফুটেজ কালের কণ্ঠের হাতে রয়েছে।
টাকা আদায়কারীদের পরিচয় জানতে চাইলে এক যুবক নিজের নাম আসাদ জানিয়ে বলেন, ‘মেসার্স আদিবা এন্টারপ্রাইজের হয়ে আমরা টাকা আদায় করছি। ’ প্রতিষ্ঠানটির মালিকের পরিচয় ও মোবাইল নম্বর চাইলে ‘দেওয়া যাবে না’ বলে কেটে পড়েন তিনি।
চিড়িয়াখানার ভেতরে থাকা চারটি পাবলিক টয়লেটে দর্শনার্থীদের কাছ থেকে নির্ধারিত ফি পাঁচ টাকার পরিবর্তে আদায় করা হচ্ছে ১০ টাকা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিড়িয়াখানার একজন কর্মী জানান, সীমানা (১৮৬.৬৩ একর) অনেক বড় হওয়ায় চিড়িয়াখানার পুরোটা ঘুরতে দর্শনার্থীদের তিন-চার ঘণ্টা সময় লাগে। প্রতিদিন গড়ে চিড়িয়াখানায় ১৫ হাজার মানুষ এলে তাদের মধ্যে অন্তত ১০ হাজার টয়লেট ব্যবহার করে। প্রতিজনের কাছ থেকে পাঁচ টাকা করে বেশি নেওয়ায় প্রতিদিন ইজারাদার অতিরিক্ত আদায় করছেন ৫০ হাজার টাকা। মাসে এই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ১৫ লাখ আর বছরে এক কোটি ৮০ লাখ টাকা।
চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর আট লাখ ১৭ হাজার টাকায় প্রধান গেটের পাশের পাবলিক টয়লেটটি ইজারা দেওয়া হয়েছে মেসার্স নাহার কনস্ট্রাকশনকে। মেসার্স নুর ট্রেডার্সকে সাত লাখ ১৪ হাজার টাকায় ইজারা দেওয়া হয় উদের ঘরের পাশের পাবলিক টয়লেট। ৯ লাখ ৫২ হাজার টাকায় শিশু পার্কের পাশের পাবলিক টয়লেটটি ইজারা দেওয়া হয় মেসার্স মা এন্টারপ্রাইজকে। মেসার্স মামুন ট্রেডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান ১২ লাখ ৬৮ হাজার ৭০২ টাকায় ইজার নেয় টাইগার মঠ সংলগ্ন পাবলিক টয়লেট। এই ইজারাদারদের সবাই চিড়িয়াখানার আশপাশের এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি।
চিড়িয়াখানার ভেতরে রয়েছে ১২ ধরনের ফলের গাছ। ফরিদ মিয়া নামের একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানান, এ বছর ফলের মৌসুমে এসব গাছের ফল সাড়ে আট লাখ টাকায় বিক্রি করা হয় ইজারাদারের কাছে। ইজারাদার গাছ থেকে ফল পেড়ে দর্শনার্থীদের কাছে বিক্রি করেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক কর্মী জানান, এসব গাছের ফল কোটি টাকার বেশি বিক্রি হয়। স্থানীয় প্রভাবশালীরা এসব সুবিধা নিচ্ছে।
চিড়িয়াখানার ভেতরের শিশু পার্কটি ইজারা দেওয়া হয়েছে মেসার্স জুনায়েত এন্টারপ্রাইজকে। পার্কে থাকা ট্রেনে চাপতে প্রতি শিশুর কাছ থেকে নেওয়া হয় ৪০ টাকা। মেরি গো রাউন্ডের জন্য নেওয়া হচ্ছে ৩০ টাকা। বিক্রমপুর থেকে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী শাহেলা বেগম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারি উদ্যোগে চিড়িয়াখানায় শিশু পার্ক করা হয়েছে। যেভাবে এখানে বাড়তি ফি নেওয়া হচ্ছে তাতে সাধারণ মানুষ শিশুদের নিয়ে এই পার্কে আসতে পারবে না। ’
অভিযোগ রয়েছে, ইজারাদাররা মিলে চিড়িয়াখানায় হকারদেরও একটি সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছে। নির্দিষ্ট অর্থের বিনিময়ে চিড়িয়াখানার ভেতরে প্রবেশ করানো হয় নির্দিষ্ট হকারদের। এই হকাররা দর্শনার্থীদের নিম্নমানের পণ্য গছিয়ে দিয়ে আদায় করে নিচ্ছে বাড়তি টাকা।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চিড়িয়াখানার ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও কিউরেটর মুজিবর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পাবলিক টয়লেট ও পার্কিংয়ে বেশি অর্থ আদায় করা হচ্ছে, বিষয়টি আমি জানতাম না। এখন জানলাম। জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেব। ইজারাদাররা কেন পাঁচ টাকার স্থলে ১০ টাকা নিচ্ছে, সে বিষয়ে অবশ্যই তাদের জবাবদিহি করতে হবে। আর আমরা দ্রুত পাবলিক টয়লেট ও পার্কিং এলাকায় সেবার মূল্যতালিকা টাঙিয়ে দেব। ’
এ জাতীয় আরো খবর..