‘আসেন কী লাগব। যেইডা চান হেইডাই পাইবেন। বাবা নিলে ৫০০ টাকা, এক পোঁটলা ঝাঁজ (গাঁজা) নিলে ৫০, বিদেশি (হেরোইন) নিলে এক হাজার ২০০। ’ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে এভাবেই কয়েক দিন আগে রাত ১২টার দিকে রাজধানীর কারওয়ান বাজার রেলগেট এলাকায় কয়েক যুবক প্রকাশ্যে মাদকের দাম হাঁকছিলেন।
কয়েক দিন ধরে রাজধানীর হাতিরঝিল রামপুরা ব্রিজসংলগ্ন এলাকা, মিরপুরের পল্লবী এলাকার বিহারি ক্যাম্প এলাকাসহ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের আশপাশ এলাকা, কমলাপুর রেলস্টেশন-সংলগ্ন এলাকাসহ অন্তত ২৩টি স্পট ঘুরে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির চিত্র দেখা যায়। তবে রাজধানীর ৫০টি থানার পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতিটি এলাকায়ই একাধিক স্পট রয়েছে। পুলিশ গত এক বছরে ২৫৭টি স্পট চিহ্নিত করেছে। অনেক স্পট তাদের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। কিন্তু কালের কণ্ঠের অনুসন্ধানে জানা গেছে, অন্তত তিন শতাধিক স্পটে নিয়মিত অনেকটা প্রকাশ্যেই মাদক কারবার চলছে। প্রতিদিন রাজধানীতে বিক্রি করা হয় সাড়ে ১৫ লাখ ইয়াবা।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) তথ্য মতে, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিভিন্ন স্পটে সক্রিয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার মাদক কারবারিকে তারা গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছে।
ডিএনসির সর্বশেষ পরিসংখ্যান বলছে, গত বছর (২০২১) সব সংস্থা মিলে তিন কোটি ৬৩ লাখ ৮১ হাজার ইয়াবা জব্দ করেছে। ফেনসিডিল উদ্ধার করা হয়েছে ১০ লাখ আট হাজার বোতল। প্রায় চার কেজি কোকেন ও ২১০ কেজি হেরোইন জব্দ করা হয়েছে। মাদকসংক্রান্ত ৪৭ শতাংশ মামলায় অপরাধীর সাজা হয়েছে। ২০২০ সালে এই হার ছিল ৪৩ শতাংশ। এ ছাড়া গত বছর ১৩ হাজার ৯০৫টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে পাঁচ হাজার ২০৬ জনকে গ্রেপ্তার করে সাজা দেওয়া হয়েছে। আগের বছর ২৩ হাজার ১৯৩টি ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ১০ হাজার ৪৯৮ জনকে দণ্ড দেওয়া হয়।
দেশে বর্তমানে প্রায় ৩০ ধরনের মাদকের মধ্যে ইয়াবা বেশি সেবন করা হয় জানিয়ে সূত্র বলছে, দেশে প্রতিদিন প্রায় ৭০ লাখ ইয়াবা বিক্রি করা হয়, এর মধ্যে রাজধানীতে বিক্রি হয় অন্তত ১৫ লাখ। প্রতিটি ইয়াবার দাম ৩০০ টাকা হলে ৭০ লাখ ইয়াবার দাম দাঁড়ায় ২১০ কোটি টাকা।
নতুন মাদকে আতঙ্ক
সম্প্রতি এক ধরনের নতুন মাদকের উদ্ভব ঘটেছে রাজধানীতে। সাধারণত এই মাদক কারো টাকা-পয়সাসহ সঙ্গের জিনিস লুট করার জন্য তার শরীরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এতে সে মস্তিষ্কের নিয়ন্ত্রণ হারায়। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, ‘স্কোপোলামিন’ নামক এই মাদক মূলত লিকুইড ও শুকনা ধরনের হয়। এটি ‘হেলুসিনেটিক’ মাদক।
মাদক কারবারিরা এর নাম দিয়েছে, ‘ডেভিলস ব্রেথ বা শয়তানের শ্বাস’। মূলত ছয় থেকে ১২ ইঞ্চি দূরত্ব থেকে শ্বাসের মাধ্যমে এই মাদক শরীরে প্রবেশ করানো হয়, যার প্রতিক্রিয়া থাকে প্রায় ২০ থেকে ৬০ মিনিট। এ অবস্থায় তাদের সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সাসহ জিনিসপত্র মাদক কারবারিরা ছিনিয়ে নেয়।
কোতোয়ালি থানার ওসি মিজানুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সম্প্রতি ‘স্কোপোলামিন’ নামের নতুন এক মাদকের কথা শোনা যাচ্ছে, যা ব্যবহার করে মানুষের কাছ থেকে কৌশলে টাকা, স্বর্ণালংকারসহ বিভিন্ন ধরনের গুরুত্বপূর্ণ জিনিসপত্র হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। তবে আমরা এই মাদক কারবারিদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছি।
ভুক্তভোগীরা যা বলছেন
ডলি ইসলাম (৫৫) নামের এক নারী জানান, তিনি দোলাইরপাড় এলাকায় থাকেন। গত বছরে এক বিশেষ মাদক কৌশলে তার নাক দিয়ে প্রবেশ করিয়ে গলার স্বর্ণের চেন, কানের দুল, একটি মোবাইল ফোন ও নগদ চার হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। ঘটনার বর্ণনায় তিনি বলেন, ‘দোলাইরপাড় ৩ নম্বর গলি দিয়ে হেঁটে সামনের দিকে আগানোর সময় এক নারী আমার সামনে এসে বলেন, সামনে এতিম খানা, সেখানে কিছু টাকা দিলে সোয়াব পাবেন। আমি দিতে না চাইলে ওই নারী আমার সামনে এসে মাথায় হাত রাখে। এরপর কিছু একটা আমার নাকের সামনে ধরে। আমি মুহূর্তে অনেকটা ঘোরের মধ্যে পড়ে যাই। এরপর সে আমার গলায় থাকা স্বর্ণের চেন, কানের দুলসহ মোবাইল ও টাকা নিয়ে চলে যায়। ঘটনার রাতেই আমার ছেলে কোতোয়ালি থানায় গিয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে। তখন থানা থেকে ছেলেকে বলা হয়, এমন ঘটনা এলাকায় আরো অনেকের ঘটেছে। ’
মোহাম্মদপুর এলাকার জোবায়ের আহমেদ বলেন, ‘রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় এক লোক আমার হাতে একটি কাগজ দিয়ে ঠিকানা জানতে চান, কিছুক্ষণের মধ্যে সে আমার নাকের কাছে এক ধরনের মাদক জাতীয় কিছু ধরে। এরপর আমার কাছে থাকা মোবাইল ফোন ও ৪০ হাজার টাকা নিয়ে নেয়। অনেকক্ষণ পর নিজে কিছুটা স্বাভাবিক হলে ঘটনা মনে পড়ে। রাজধানীর মিরপুর এলাকার সানিয়া আক্তার ও জায়েদা খাতুন নামের দুই নারীও এই মাদক কারবারিদের খপ্পরে পড়ে টাকা, মোবাইল ফোন খুইয়েছেন।
মাদক কারবারিরা বিভিন্ন বয়সীদের যৌন মিলনে বাধ্য করতে মাদকটি ব্যবহার করে বলেও অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করছে পুলিশ। পর্নোগ্রাফিক ভিডিও রেকর্ড করতে বা নগ্ন ছবি তোলার জন্যও এই মাদক ব্যবহার করা হয়।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক (ঢাকা মেট্রো উত্তর) মেহেদী হাসান বলেন, ‘আমরা ‘স্কোপোলামিন’ মাদক সম্পর্কে শুনেছি। তবে এখনো খোঁজ পাইনি। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, সব ধরনের মাদক কারবারিদের গ্রেপ্তার করতে অভিযান অব্যাহত আছে।
এর আগে দেশে প্রথমবারের মতো ‘ক’ শ্রেণির মাদক ডাইমেথক্সিব্রোমো অ্যাম্ফেটামিন (ডিওবি) জব্দ করে ডিএনসি। অধিদপ্তরের কেমিক্যাল বিশেষজ্ঞরা জানান, কেউ ডিওবি সেবন করার পর তাকে প্রভাবিত করা যায়। নির্দেশিত কাজ করতে সে বাধ্য হয়। ডার্ক ওয়েবসাইটে ক্রিপ্টোকারেন্সির মাধ্যমে পোল্যান্ড থেকে ২০০ ব্লট ডিওবি অর্ডার করেন খুলনার যুবক আসিফ আহমেদ শুভ। অর্ডারের পর ইন্টারন্যাশনাল কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে মাদকের চালানটি সরাসরি তাঁর বাসায় পৌঁছায়। তাঁকে গ্রেপ্তার করে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
যেসব এলাকায় মাদক কারবার
সরেজমিনে মোহাম্মদপুরের গজনবী রোড, বাবর রোড, শাহজাহান রোড, হুমায়ুন রোডে গিয়ে দেখা গেছে, চারটি রোডেই রয়েছে পুলিশের তল্লাশি চৌকি। মাঝখানের ক্যাম্পে দিন-রাত চলছে মাদক বেচাকেনা। জানা গেছে, অন্তত ২০ জনের নিয়ন্ত্রণে মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে চলে মাদক কারবার। আর তেজগাঁও রেল বস্তি, বনানীর কড়াইল বস্তি, সবুজবাগের ওহাব কলোনি, কামরাঙ্গীর চর, মতিঝিলের এজিবি কলোনিতে মাদক বাণিজ্য চলে অর্ধশতাধিক মাদক কারবারির নিয়ন্ত্রণে।
সম্প্রতি পল্লবী বিহারি ক্যাম্প এলাকায় ১৩ জন মাদক কারবারির সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের একজন সবুজ। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, রাজধানীর বিহারি ক্যাম্পগুলোয় অন্তত ১৫টি গ্রুপ রয়েছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে মাদক কারবারিদের। স্থানীয় ওয়ার্ড পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কিছু সদস্যও তাদের মাদক কারবারে সহযোগিতা করেন।
২০১৮ সালের ৪ মে থেকে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করেছিল র্যাব। এরপর পৃথকভাবে মাদক নিয়ন্ত্রণে অভিযান অব্যাহত রেখেছে পুলিশ, বিজিবি ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। বিভন্ন সময়ে ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনায় অনেক মাদক কারবারি নিহত হয়েছে। এর পরও মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে আসেনি। এ ছাড়া মাদক নিয়ন্ত্রণে ঢাকা ও টেকনাফের জন্য গঠন করা হয়েছে বিশেষ টাস্কফোর্স। এর আওতায় সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর ও সীমান্ত এলাকায় নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, বর্তমানে দেশে মাদকাসক্ত মানুষের সংখ্যা ৮০ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৮০ শতাংশই যুবক। মোট মাদকাসক্তের মধ্যে ৪৮ শতাংশ শিক্ষিত। মাদকাসক্তদের মধ্যে ৫৭ শতাংশ আবার যৌন অপরাধী। জেলখানায় যত মানুষ আছে এর বেশির ভাগই মাদক পাচারকারী কিংবা কারবারি।
এ জাতীয় আরো খবর..