ঈদের ছুটিতে লাখো পর্যটক দেশ ও দেশের বাইরে বেড়াতে যাবেন। করোনার এ সময়ে স্বাস্থ্যবিধি না মানলে বিপদের আশঙ্কা বেশি। আসুন, সবাই সচেতন হয়ে ভ্রমণ করি আর জেনে নিই এ সময়ে দেশের আশপাশে কোথায় কোথায় বেড়াতে যেতে পারেন। খোঁজখবর নিয়ে লিখেছেন বিয়ন্ড অ্যাডভেঞ্চার অ্যান্ড ট্যুরিজমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ আখতারুজ্জামান
ভারত : বাংলাদেশের চারপাশজুড়ে যেহেতু ভারতের অনেক রাজ্যের অবস্থান, তাই অল্প খরচে এসব জায়গায় বেড়িয়ে আসতে পারেন।
তবে সব জায়গায়ই কিছু জরুরি বিষয় আগে থেকে জেনে নেওয়া ভালো।
মেঘালয়-আসাম : বর্তমানে সিলেট অঞ্চলে ভয়াল বন্যার কথা আমরা সবাই জানি। এই বন্যার প্রভাব পড়েছে মেঘালয় এবং আসামেও। ভূমিধসের ফলে অনেক এলাকার রাস্তাঘাট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ অঞ্চলে এখন ভ্রমণ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই ভ্রমণের আগে সব তথ্য জেনে নিন। মেঘালয়ের শিলং, চেরাপুঞ্জি, মাউফলং ও মাউলিনং গ্রাম বিখ্যাত পর্যটন স্থান। আর আসামের গুয়াহাটি ও কামরূপ কামাখ্যা নিশ্চয়ই ঘুরে আসবেন।
ত্রিপুরা : আখাউড়া বর্ডার থেকে সহজেই ত্রিপুরা যাওয়া যায়। আগরতলা শহর, জলমহল, ঊনকোটিসহ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিজড়িত অনেক স্থান ঘুরে দেখতে পারবেন এখানে। কমপক্ষে চার-পাঁচ দিন সময় হাতে নিয়ে যাবেন। ঊনকোটি যাওয়ার রাস্তা পাহাড়ি। সাবধানতা অবলম্বন করবেন।
দার্জিলিং-সিকিম : দার্জিলিংয়ে এখন মনোরম পরিবেশ। এখানে প্রতিটি ঋতুর সৌন্দর্যই উপভোগ করার মতো। ভাগ্য প্রসন্ন থাকলে হোটেল রুমের জানালা থেকেই দেখতে পাবেন অপরূপ কাঞ্চনজঙ্ঘা। বৃষ্টি হলেও উপভোগ করতে পারবেন সবুজ চা-বাগানের স্নিগ্ধতা। কিছু চা-বাগান সংলগ্ন রিসোর্ট আছে দার্জিলিংয়ে, যা এতই অসাধারণ ও ঐতিহ্যমণ্ডিত যে সারা পৃথিবীর মধ্যে অনন্য। তবে এই সময়ে দার্জিলিং ভ্রমণের সঙ্গে ডুয়ার্সের অরণ্যভ্রমণ মিস করবেন। ১৫ জুন থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর প্রজনন ঋতুর কারণে জঙ্গলভ্রমণ বন্ধ থাকবে। আসছে শীতে প্ল্যান করতে পারেন। তখন যাঁরা ট্রেকিং পছন্দ করেন, বান্দরবানের পাহাড়ে ট্রেকিং করেছেন, তাঁরা আরেকটু উচ্চমাত্রার ট্রেকিং করতে দার্জিলিং ভ্রমণের পাশাপাশি মানেভঞ্জন হয়ে সান্দাকফু পর্যন্ত ট্রেকিং করতে পারেন। সিকিমেও বেড়াতে যেতে পারেন। তবে পাহাড়ভ্রমণের আদর্শ সময় মার্চ থেকে মে এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি।
কলকাতা : এই এক শহর, যা বাংলাদেশি পর্যটকদের কাছে বছরজুড়েই পছন্দের তালিকার শীর্ষে। তবে কলকাতা শহরও অনেকে ভালো করে ঘোরেন না। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আর কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউস ছাড়াও এখানে আরো অনেক কিছু দেখার আছে। নিউ মার্কেটে শপিং করার পাশাপাশি স্বামী বিবেকানন্দ, নেতাজি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, বেগম রোকেয়া, মাদার তেরেসা, সত্যজিৎ রায়, উত্তম কুমার, সুচিত্রা সেন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিবিজড়িত স্থানগুলো দেখে আসুন। আরো বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা ও স্থান এই শহরের আনাচকানাচে হীরার খনির মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ইস, এই জায়গাগুলো দেখতে দেখতে যদি সেই সব ইতিহাসের গল্পগুলো শুনতে পারতেন! কলকাতা শহরের বাইরেও দু-এক দিন সময় নিয়ে পুরুলিয়া, দীঘা, মায়পুর, মুর্শিদাবাদ, শান্তিনিকেতনসহ আরো অনেক জায়গায় বেড়িয়ে আসতে পারেন।
নেপাল : হিমালয়কন্যা নেপালে বছরজুড়েই বেড়ানো যায়। এয়ার টিকিটের ভাড়া পড়বে জনপ্রতি ৪০ হাজার টাকার মতো। ঘুরে দেখতে পারেন কাঠমাণ্ডু, পোখার, নাগরকোট, ধুলিখেল আর চিতওয়ানের মতো দৃষ্টিনন্দন জায়গাগুলো, যদিও ট্রেকিং সিজন না থাকায় বছরের এই সময়ে এভারেস্ট বা অন্নপূর্ণা বেইস ক্যাম্পে যেতে পারবেন না। এখানে ট্রেকিংয়ের মৌসুম মার্চ থেকে মে এবং সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত।
থাইল্যান্ড : থাইল্যান্ড ভ্রমণে কভিডের পর নানা বিধি-নিষেধ থাকলেও এখন আর কোনো সমস্যা নেই। বলতে গেলে একেবারে আগের মতোই থাইল্যান্ড ভ্রমণ করা যায়, যদিও বিশ্ববিখ্যাত এই পর্যটন দেশটি এখনো আগের মতো জমজমাট হয়ে ওঠেনি। রাস্তাঘাট এখনো প্রায় জনশূন্য। তাই নিরিবিলিতে থাইল্যান্ড ভ্রমণের এখনই শ্রেষ্ঠ সময়। ঘুরে আসতে পারেন ব্যাংকক, পাতায়া, ফুকেট, ক্রাবি বা কোহ সামুই। এয়ার টিকিটের ভাড়া পড়বে ৩০ থেকে ৪০ হাজার টাকার মতো।
সিঙ্গাপুর : বিলাসবহুল ভ্রমণের জন্য এশিয়ার মধ্যে সিঙ্গাপুর অন্যতম সেরা গন্তব্যস্থল। এই ব্যয় পুষিয়ে নিতে অনেকে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে আরো একটি বা দুটি দেশ ভ্রমণ পরিকল্পনা করে থাকেন। এতে এয়ার টিকিটের খরচটা তুলনামূলক কম পড়ে। বর্তমানে যদিও এই বিমানভাড়া আগের তুলনায় অত্যধিক। জনপ্রতি অন্তত ৫০ হাজার টাকা হতে পারে। তবে ভ্রমণের দু-এক মাস আগে টিকিট কাটতে পারলে আরো কমে পাওয়া যেতে পারে।
মালয়েশিয়া : মালয়েশিয়া ভ্রমণে এখন স্টিকার ভিসার পরিবর্তে ই-ভিসা দেওয়া হচ্ছে। সাত থেকে ১০ কর্মদিবস সময় লাগে। মালয়েশিয়ান এয়ারে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করলে অনেক কম খরচে দুই দেশ ভ্রমণের বিমান টিকিট কাটতে পারবেন। কুয়ালালামপুর, ল্যাংকাউয়ি ও পেনাংয়ের সঙ্গে ঘুরে আসতে পারেন মালাক্কা ও জোহরবাহরো কিংবা কোটা কিনাবালু।
ইন্দোনেশিয়া : ইন্দোনেশিয়ার বালি সম্পর্কে কে না জানে! বিশ্ববিখ্যাত এই দ্বীপ ভ্রমণ করে আসতে পারেন। তবে মালয়েশিয়া বা সিঙ্গাপুরও একসঙ্গে ভ্রমণতালিকায় রাখলে বিমানভাড়া সাশ্রয়ী হবে। যেহেতু ঢাকা থেকে সরাসরি বালিতে কোনো ফ্লাইট নেই। তাই ব্যাংকক, সিঙ্গাপুর বা কুয়ালালামপুর হয়েই আপনাকে যেতে হবে। তাই যাত্রাপথে এই দেশগুলোতেও দু-চার দিন বেড়িয়ে নিতে পারেন। বালিতে গেলে লম্বকের গিলি ত্রাভাঙ্গান দ্বীপটিও ঘুরে আসবেন।
শ্রীলঙ্কা-মালদ্বীপ : সম্প্রতি মুদ্রাস্ফীতি ও অর্থনৈতিক মন্দার ফলে রাজনৈতিক অস্থিরতায় জর্জরিত শ্রীলঙ্কা। বর্তমানে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণসেবা ও নিরাপত্তা প্রশ্নের সম্মুখীন। ফলে শ্রীলঙ্কা ভ্রমণের আগে দেশটির বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নেবেন। তবে এখন মালদ্বীপ ভ্রমণপিপাসু পর্যটকদের জন্য সুখবর হচ্ছে ঢাকা থেকে রাজধানী মালেতে এখন সরাসরি ফ্লাইট আছে। জনপ্রতি ভাড়া পড়বে আনুমানিক ৪০ হাজার টাকা। মালদ্বীপ ভ্রমণে খরচ কমানোর জন্য পুরোটা সময় তাজ এক্সোটিকা বা প্যারাডাইসের মতো প্রাইভেট দ্বীপ-রিসোর্টে না থেকে দু-এক দিন পাবলিক দ্বীপ-রিসোর্ট বা হোটেলে থাকুন। যেমন—মাফুশি, ফুলিধু, গুরাইধু, থুলুসধু ইত্যাদি।
ভুটান : এই লেখা পর্যন্ত ভুটান পর্যটকদের জন্য তার দুয়ার খোলেনি। তবে সেপ্টেম্বর (২০২২) থেকে খুলে দেওয়ার আয়োজন চলছে।
কিছু জরুরি ভ্রমণ পরামর্শ
কভিড-১৯-এর তীব্রতা কমে গেলেও সতর্কতার যেন কমতি না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবেন, বিশেষ করে শিশুদের ও পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি।
ডাবল ডোজ ভ্যাকসিন নেওয়া থাকলে এখন কোনো দেশেই ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা নেই, যদিও যাঁদের ভ্যাকসিন দেওয়া নেই, তাঁদের কভিড টেস্ট করিয়ে নেগেটিভ রেজাল্ট নিয়ে ভ্রমণ করতে হবে। সে ক্ষেত্রে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভ্রমণের ৪৮ থেকে ৭২ ঘণ্টা আগে টেস্ট করাতে হয়। একেক দেশের ক্ষেত্রে এই নিয়ম যেকোনো সময় পরিবর্তিত হতে পারে। ভ্রমণে এসংক্রান্ত বিধিমালা সম্পর্কে হালনগাদ তথ্য জেনে নেবেন।
জুন-জুলাই মাসে গরমের তীব্রতা বেশি। সঙ্গে শিশুরা বা বৃদ্ধরা থাকলে ভ্রমণে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করুন। বাইরের গরম এবং ভেতরে (গাড়ি বা হোটেলের) এসির ঠাণ্ডায় অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা বেশি থাকবে।
তুলনামূলকভাবে এখন বিমানভাড়া অনেক বেশি। তাই ভ্রমণের যতটা আগেভাগে সম্ভব বিমানের টিকিট কেটে ফেলুন। ভিসা প্রসেসিংয়ে এখন আগের চেয়ে বেশি সময় লাগছে। তাই নির্ধারিত ভ্রমণ তারিখের আগেই ভিসা করিয়ে নিন। যেহেতু কভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে কেবল ভ্রমণ শুরু হয়েছে, সেহেতু অনেক গন্তব্যে এখন আগের নিয়ম চলছে না। অনেক কিছু পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাই পেশাদার ট্যুর অপারেটরদের সহায়তা নিন।
এ জাতীয় আরো খবর..