মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তির রীতিমতো ‘হরিলুট’ চলছে। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এই ট্রাস্টের সম্পত্তি বেদখল হয়ে গেছে। যারা দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন, তাদের অনেকে তা দখল করে নিয়েছেন। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে ট্রাস্টের দোকান, বাড়ি ও মার্কেট ভাড়া দেওয়া হয়েছে পানির দরে।
তবে এই কম ভাড়ার নেপথ্যে একটি চক্র গোপনে মোটা অঙ্কের অর্থ লেনদেন করছেন-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। তাদের মতে, একসময় বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন করত ট্রাস্টের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। এসব পণ্য বাজারে জনপ্রিয় হলেও কখনোই লাভের মুখ দেখেনি। ওই চক্রের সদস্যরা ‘লাভের গুড়’ খেয়ে ফেলেছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ট্রাস্টের বন্ধ হওয়া সব সম্পত্তি বিক্রি করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। যুগান্তরের অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।
দেশের বীর সন্তান যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের সচ্ছলতা নিশ্চিতসহ তাদের কল্যাণে ১৯৭২ সালে এই ট্রাস্ট গঠন করেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাজধানী ঢাকা ও চট্টগ্রামে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টকে ১৮টি লাভজনক শিল্পপ্রতিষ্ঠান দেওয়ার মাধ্যমে যাত্রা শুরু হয় ট্রাস্টের। ১৯৭৭ সালে শিল্প মন্ত্রণালয় আরও ১১টি প্রতিষ্ঠান ট্রাস্টকে দিয়েছিল এবং ট্রাস্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আরও ৩টি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেছিল। মোট ৩২টি প্রতিষ্ঠান থেকে শুধু রাজধানীর টয়েনবি সার্কুলার রোডে পূর্ণিমা ফিলিং অ্যান্ড সার্ভিস স্টেশন নামের ১টি প্রতিষ্ঠান চালু রয়েছে।
বাকি ৩১টি প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। বন্ধ হওয়া প্রতিষ্ঠানের সর্বশেষ অবস্থা ও বর্তমান বাজারমূল্য নির্ধারণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এরপর এসব সম্পদ বিক্রির বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সারসংক্ষেপ পাঠানো হয়। ২৭ মার্চ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে পাঠানো চিঠিতে কল্যাণ ট্রাস্টের সম্পত্তি বিক্রির বিষয়ে সুপারিশ করা হয়। এদিকে কল্যাণ ট্রাস্টের সুবিধাভোগী মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল মালেক যুগান্তরকে বলেন, ট্রাস্টের সম্পত্তিসহ প্রতিষ্ঠানগুলোর বর্তমান বাজারমূল্য আছে প্রায় ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দুর্নীতি ও অদক্ষতার কারণে ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠানগুলো আজ বিক্রি করে দিচ্ছে সরকার।
ট্রাস্টের সম্পত্তির বিষয়ে জানতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, একটি চক্র নিজেদের লাভের জন্য যেভাবে পারছে সেভাবেই ট্রাস্টের সম্পত্তি বিভিন্ন উপায়ে দখল করে রাখছেন এবং অনেক জায়গায় মামলা-মোকদ্দমা করেও ট্রাস্টের বিপুল সম্পত্তি কুক্ষিগত করে রাখার অপতৎপরতা লক্ষ করা যাচ্ছে। কাজেই সম্পত্তিগুলো বিক্রি ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পড়ে থাকা সব সম্পত্তি বিক্রির ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছেন। ট্রাস্টের কল্যাণকর যা হবে, আমরা সেই লক্ষ্যেই এগোচ্ছি।
জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বিশেষ করে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও শহিদ মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের কল্যাণের জন্যই মূলত দেশ স্বাধীনের পর বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট গঠন করেন। পরে এই ট্রাস্টকে বিভিন্ন সম্পত্তি দেওয়া হয়। সিনেমা হল, রেস্তোরাঁ, ফিলিং স্টেশন, বেভারেজ, ভোজ্য তেল, চকলেট, প্যাকেজিং, গ্লাস ও অ্যালুমিনিয়াম, রাবার, রাসায়নিক, চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন করে ব্যবসা করার জন্য নেমেছিল মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। গত ৪৯ বছরেও ট্রাস্ট লাভের দেখা পায়নি অথচ যারা বিভিন্ন সময়ে রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন, তারা নিজেদের মতো করে হরিলুট করেছেন এবং সেই হরিলুটের টাকায় ঠিকই নিজেদের ভাগ্যবদল করে নিয়েছেন-এমন অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। একটি বিশেষ মহলের সঙ্গে ট্রাস্টের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীর গোপন আঁতাঁতের কারণে প্রতিষ্ঠানটি কোটি কোটি টাকার আয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে রাজধানী সুপার মার্কেট ও গুলিস্তান কমপ্লেক্স থেকে প্রতিবছর যে অঙ্কের অর্থ পাওয়ার কথা ছিল, এর শতকরা ১০ ভাগ পায় কি না সন্দেহ! অনেকেরই প্রশ্ন-এত টাকা যায় কোথায়?
তবে অনুসন্ধানে জানা যায়, বছরের পর বছর ট্রাস্টের সম্পত্তি ব্যবহার করে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেছেন ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জু ও আজমল হোসেন বাবুল। এভাবেই তারা দুজনেই শতকোটি টাকার মালিক হয়েছেন-এমন অভিযোগ মার্কেট ব্যবসায়ীদের। তারা জানান, রাজধানী সুপার মার্কেটের প্রায় দুই হাজারের বেশি দোকান রয়েছে। ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে অবৈধভাবে মার্কেটটির পদ দখল করে এ দুজন বহু টাকার মালিক বনে গেছেন। বর্তমানে এই মার্কেটের সভাপতি হলেন আজমল হোসেন বাবুলের ছোটো ভাই আবু নাসের সেন্টু ও সাধারণ সম্পাদক তার (বাবুল) ছেলে ফজলুল হক বিপ্লব। ঘুরেফিরে এই চক্রের কাছে জিম্মি মার্কেটের ব্যবসায়ীরা।
সাবেক কাউন্সিলর ময়নুল হক মঞ্জুও মার্কেটের দখলে নানা তৎপরত চালাচ্ছেন-এমন অভিযোগ মার্কেট ব্যবসায়ীদের। বাবুল ও মঞ্জুর সম্পর্ক ‘সাপে নেউলের’ মতো ভয়ংকর। তাদের রয়েছে বিশাল ক্যাডার বাহিনী। অন্যদিকে এই ট্রাস্টের অন্যতম একটি সম্পত্তি হচ্ছে গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স, যা ২০০১ সালে ২০তলা ভবন নির্মাণের লক্ষ্যে ‘দ্য ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ার্স লিমিটেড’কে চুক্তি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ডেভেলপার কোম্পানি ৯তলা পর্যন্ত কাজ করেই নিজেদের আখের গুছিয়ে ট্রাস্টকে ঠকিয়ে সরে যায়। এখন আবার বিভিন্ন দপ্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছেন ওই কোম্পানির মালিক এসএম আলাউদ্দিন বাকি ১১তলা সম্পূর্ণ করার জন্য। ইতোমধ্যেই এই মার্কেট ঘিরে গড়ে উঠেছে প্রভাবশালী দখলদারদের একটি চক্র।
গুলিস্তান এলাকার ব্যবসায়ী কামাল বলেন, ‘মার্কেটের নেতাদের দেখলে মনে হয়, তারা যেন তাদের পৈতৃক ব্যবসাবাণিজ্য নিয়ে বসেছে, যা আসবে তা খালি পকেটে ভরে নিয়ে যাবে। আর ট্রাস্ট হইছে তাদের কামলা, তারা যা দিবে, তা নিয়ে চুপ কইরা থাকতে হবে। এটা চরম অন্যায়। যেভাবে ট্রাস্টকে ঠকাচ্ছে, এতে মুক্তিযোদ্ধাদের হক নষ্ট করা হচ্ছে।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, জনৈক রফিকুল ইসলামের সঙ্গে ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে মার্কেটটির বেজমেন্টে ৩২ হাজার ২১১ বর্গফুট জায়গা ১০ টাকা হারে ভাড়ার চুক্তি হয়। কার পার্কিংয়ের নামে বরাদ্দ নিলেও কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই ২৪টি গোডাউন, পূর্বদিকের গাড়ি আসা-যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে ১০টি দোকান ও একটি কম্বল কারখানা তৈরি করা হয়েছে। পাশাপাশি মার্কেটের পাশে ফুটপাতে ৬ শতাধিক চৌকি ১ হাজার ফলের ঝুড়ি রাখার জন্য ভাড়া দিয়ে মাসে ২০ থেকে ২৫ লাখ টাকা আয় করছেন রফিকুল ইসলাম। অবৈধভাবে প্রাপ্ত এই টাকার কিছু অংশ দিয়ে ট্রাস্টের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে বহাল তবিয়তে রয়েছেন তিনি। অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে মার্কেটগুলো থেকে কাঙ্ক্ষিত আয় নেই।
বেদখলে সম্পত্তি : ঢাকা, চট্টগ্রাম, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জসহ মোট ৬৬ একর জমির মধ্যে ট্রাস্টের দখলে আছে প্রায় ৬২ একর। বাকি জমি ট্রাস্টের অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় বিভিন্ন ব্যক্তি দখল করে মামলা করে রেখেছে। এসব বেদখল জমি উদ্ধারে কোনো তৎপরতা নেই। এসব মামলা ১৮ থেকে ২০ বছর ধরে ঝুলছে। আর রাজধানী সুপার মার্কেটের ৫৬ শতাংশ জমি মহানগর জরিপে অন্যের নামে রেকর্ড হয়ে আছে বলে জানা গেছে।
এছাড়া হরদেও গ্লাস অ্যান্ড অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কস ১৯৯০ সালে বন্ধ হয়ে গেলেও ওই কারখানার ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকরা এখনো ৭৫ দশমিক ৩২ শতক জমিতে ঘর তুলে বসবাস করছেন। অনিল কুমার মুখার্জি নামে এক ব্যক্তি জমির মালিকানা দাবি করে মামলা করে রাখায় ওই জমি পুনর্দখলের কোনো উদ্যোগ নিতে পারছে না ট্রাস্ট। এভাবেই প্রায় ৪ একর জমি বিভিন্ন পন্থায় একটি চক্র দখলে রেখেছে।
পানির ধরে দোকান ভাড়া : রাজধানীর প্রাণকেন্দ্র গুলিস্তানে নাজ সিনেমা হল ভেঙে গুলিস্তান শপিং কমপ্লেক্স নির্মাণ করেছে ট্রাস্ট। এই কমপ্লেক্সের ১ হাজার ৭৪টি দোকান থেকে মাসে ১২ লাখ টাকা ভাড়া পায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্ট। অর্থাৎ প্রতিটি দোকানের মাসিক ভাড়া মাত্র ১১০০ টাকা। গুলিস্তানের মতো জায়গায় যদি মার্কেটের প্রকৃত দোকান ভাড়া আসত তবে প্রতি দোকানের ভাড়া কমপক্ষে ১০-১৫ হাজার টাকা হওয়ার কথা।
এছাড়া টিকাটুলি হাটখোলা রোডে হরদেও গ্লাস অ্যান্ড অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কসের ৩ দশমিক ৮২ একর জমির ওপর গড়ে তোলা হয় রাজধানী ও নিউ রাজধানী সুপার মার্কেট। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-মার্কেটের প্রতিটি দোকান থেকে ১০ হাজার টাকার ওপরে মাসিক ভাড়া আদায় করা হয় অথচ কল্যাণ ট্রাস্টের তহবিলে জমা দেওয়া হয় মাত্র এক হাজার টাকা। রাজধানী সুপার মার্কেটে প্রায় দুই হাজার দোকান রয়েছে, যা থেকে কল্যাণ ট্রাস্ট পায় প্রতিমাসে ২০ লাখ টাকা। আর বাকি ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা আজমুল হোসেন বাবুল, সেন্টু, বিপ্লব সিন্ডিকেটের পকেটে ঢুকছে।
এ জাতীয় আরো খবর..