‘নেগেটিভ! গ্রুপের রক্তের জন্য সাধারণত আগে থেকেই ডোনারের খোঁজ করতে হয়। কিন্তু সে রক্তের প্রয়োজন শুনে মুহুতের মধ্যেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যরাতে ছুটে চলার দৃশ্য ছিল মনে দাগ কাটার মতো। কেননা রাত থেকে দুপুর পর্যন্ত রক্ত দিতে ডোনারদের লাইনে দাঁড়ানোর সিরিয়াল ছিলো চোঁখে পড়ার মতো। এভাবে গত শনিবার দিবাগত রাত থেকে সকাল পর্যন্ত সীতাকুণ্ডে কনটেইনার ডিপোতে অগ্নিকাণ্ডে দগ্ধ ও আহতদের রক্তের প্রয়োজনে সাড়া দিয়ে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ছুটে যান কয়েক’শ শিক্ষার্থী।
আর এদের একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী ছাহিল কবির। তাঁর কাছ থেকে সেই গল্প শুনেছেন-মোবারক আজাদ।
‘রাত ১২ টার দিকে ফেসবুকে দেখতে পাই; চট্টগ্রাম মেডিক্যালে স্বেচ্ছাসেবকরা নেগেটিভ রক্তের ডোনার লাগবে বলে চিৎকার করছে। এসময় এক বন্ধু বলছে যাবো কিনা। তখন চট করে রাজি হয়ে যাই। তখন আমরা চার-পাঁচজন বন্ধু কোনো গাড়ি পাচ্ছিলাম না। তারপর ভাবলাম বিশ্ববিদ্যালয় মেডিক্যাল সেন্টারের একটা অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা করে নিয়ে চলে যাব। মেডিক্যাল সেন্টারে গিয়ে সহকারী প্রক্টর শহীদুল্লাহ স্যারকে কল দিয়ে বিষয়টি জানাই। তখন তিনিও রাজি হন।
এ সময়ে মধ্যে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে বিভিন্ন জন রক্তদানের আহ্বান জানায়। এরপর আমরা আলাওল, এ এফ রহমান ও সোহরাওয়ার্দী আবাসিক হলের সিনিয়র-জুনিয়রদের বলি। কল্পনাও করতে পারিনি কিছুক্ষণের মধ্যে এসব হলের মোড়ের রাস্তায় দুই শতাধিক শিক্ষার্থী জড়ো হয়ে যাবে। আবার প্রক্টর স্যারকে কল দিলাম; আমাদের লোকসংখ্যা অনেক। বাস ছাড়া এতে লোক যেতে পারবে না। পরে প্রক্টর স্যার পরিবহনপুলে আলাপ করে দ্রুত সময়ে একটি বাসের ব্যবস্থা করে দেন।
এভাবে ঘন্টা দেড় ঘন্টার মধ্যেই বাসটি শহরের উদ্দেশ্যে ছাড়ে। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাম্বুলেন্সসহ ট্রাকে ও সিএনজি করেও অনেকে গেছেন।
আমাদের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় লেখা সম্বলিত বাসটি যখন চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের গেইটের সামনে রাত ২টার দিকে গিয়ে দাঁড়ালো, সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে ছিলো! বাস ভর্তি রক্তদাতা। এ সময় হতাহতের নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স সাইরেন বাজিয়ে হাসপাতালের ভেতরে ঢুকছিল। তখন স্বেচ্ছাসেবকরা চিত্কার আসছে নেগেটিভ ডোনার এদিকে আসেন। পজিটিভ এদিকে আসেন। হাজারো মানুষের ভিড়। সাথে সাথে নির্দেশনায় মোতাবেক ডোনাররা নেমে ছুটে গেল! এরপর কিছু ডোনারদের নিয়ে বাস ছুটে গেল পার্কভিউ হাসপাতালের সামনে! কয়েকজন নেমে ভেতরে গিয়ে জেনে আসলো ব্লাড লাগবে কিনা! কর্তৃপক্ষ তখন কিছু রেজিস্ট্রি করে রাখলো।
এরপর আবার বাস ছুটে চললো সিএমএইচের উদ্দেশ্যে! চট্টগ্রাম সেনানিবাসের মেইন গেইটে সেনাবাহিনী বিস্তারিত শুনে কয়েকজনকে সেনাবাহিনীর নিজস্ব গাড়িতে করে সিএমএইচে নিয়ে গেল। সেখানে রেজিস্ট্রি শেষে সেখানেও আবার বাস আবার ছুটে গেল মেডিকেল কলেজের সামনে। ততক্ষণে ভোরের আলো অন্ধকারে ছেয়ে যাওয়া এই চট্টগ্রাম শহর আলোকিত হয়ে পড়ে। আর যারা রক্ত দিয়েছেন তাঁদেরকে ক্যাম্পাসের ছাত্রলীগসহ অন্যান্য বড় ভাইয়েরা খাওয়ার জন্য কোমল পানি ও জুস দেন। অনেককে চোখের ড্রপ কিনে দেন। এভাবে প্রাণপণ চেষ্টা শেষে সেই বাসটি তার ভেতরে থাকা মানুষগুলোকে নিয়ে সকালে নিজ গন্তব্যে যাত্রা করলো! আমাদের নানাভাবে সিনিয়র ভাইয়েরা ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সহযোগিতা করেছেন বলে আমরা তাঁদের পাশে দাঁড়াতে পেরেছি। অন্যথায় অনেকের ইচ্ছা থাকলেও মধ্যরাতে গাড়ির অভাবে ২২ কিলোমিটার দূরের ক্যাম্পাস থেকে শহরে রক্ত দিতে যেতে পারত না।
ছাহিল কবির আরো বলেন, ‘আমরা ছাত্র সমাজ সব সময় সোচ্ছার। মানবিকতার টানে আমরা যদি না যায়, তাহলে কে যাবে? যাঁরা শহরে সরাসরি যেতে পারেনি; তারাও ফেসবুকে শেয়ার করে আগ্রহীদের বার্তা দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষার্থী, শিক্ষক ও ছাত্রনেতারা তাঁদের নিজ নিজ ফেসবুকসহ বিভিন্ন গ্রুপে শেয়ার করে পাশে ছিলেন। আমরা যদি রক্ত দিয়ে তাঁদের পাশে না দাঁড়াতে পারতাম নিজেদের অপরাধী মনে হতো। ’ এভাবে ছাহিলের মতো সেদিন রাতেই অনন্ত ৭০-৮০ জন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রক্ত দিয়েছেন বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে চট্টগ্রাম মেডিক্যালে আগে থেকেই হাসপাতালের বেডে যাঁরা ভর্তি ছিলেন। বিষ্ফোরণের ঘটনায় আহত রোগীদের জায়গা করে দিতে তারা নিজেরা সিট ছেড়ে দিয়ে বাইরে বিছানা পেতে চিকিৎসা নিয়েছেন। খাবার ও ওষুধসহ নানা সহযোগিতায় এগিয়ে আসেন বিভিন্ন সংগঠন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. রবিউল হাসান ভূঁইয়া কালের কণ্ঠকে বলেন, মানবসৃষ্ট দূর্যোগ কখনো আগাম বার্তা দিয়ে আসেনা। মধ্য রাতে চট্টগ্রামবাসী ও আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা আহত রোগীদের জীবন বাঁচাতে যেভাবে এগিয়ে এসেছেন এটা মানবিকতার এক অন্যতম নজির বলা চলে। ঘটনার দিন রাতে অনন্ত ২’শ ফোন রিসিভ করি আমরা প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরা। প্রথমে একটি বাস ও অ্যাম্বুলেন্স দেয়। কারন রাতে চালকরা পরিবহনপুলে থাকেন না। পরে পর্যাক্রয়ক্রমে সকাল পর্যন্ত ছয়টি বাস দেওয়া হয়। যাতে করে ৫’র অধিক শিক্ষার্থী শহরে যান।
কি পরিমাণ রক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেভাবে হিসাব করা সম্ভব হয়নি। যাঁরা গিয়েছেন তাঁদের অনেকেই রক্ত দিয়েছেন বলে শুনেছি।
উল্লেখ্য, গত শনিবার দিবাগত রাতে সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারিতে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে ভয়াবহ আগুন লাগে। এতে ফায়ার সার্ভিস কর্মীসহ ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন দুই শতাধিক এখনো পর্যন্ত।
এ জাতীয় আরো খবর..