×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৬-১১
  • ১৯৬ বার পঠিত
রাজনৈতিক ইস্যুতে তুমুল সমালোচিত বিষয় হলো বাজেট। বিরোধী সমালোচনা শুনে বস্তুনিষ্ঠ দিকনির্দেশনা পাওয়া কঠিন। আমজনতা, যারা বাজেটে বড় বড় সংখ্যার তাৎপর্য প্রায়ই অনুধাবনে ব্যর্থ, তারা দেখে বিরোধী দলের আলোচনায় বাজেটের কোনো অংশই কখনো প্রশংসিত হয় না। সেটি আমাদের গত ৫৩ বছরের অমোঘ অভিজ্ঞতা।

সরকারের প্রস্তাবের বিকল্প কী কী হতে পারে, বরাবর তা বলা হয় না।

এবারের বাজেট সাহসী এবং সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অভিসারী। রাজনৈতিক সুবিধা বিবেচনায় উচ্চাকাঙ্ক্ষী না হয়ে বাজেটকে সাধ্যের মধ্যে রাখা হয়েছে। স্বাভাবিক সময়ের বিবেচনায় অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শেষ বর্ষে এই বাজেট হওয়ার কথা ৯ লাখ ৯২ হাজার কোটি টাকা (প্রণয়নকালে কভিডের ভয়াবহতা ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তখন বিবেচনায় ছিল না)।

উন্নয়ন বাজেট হওয়ার কথা তিন লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য প্রাক্কলিত ছিল ৮.৫১ শতাংশ। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার চার বছর শেষে সমগ্র পৃথিবী এখন নতুন বাস্তবতায় উপনীত। নতুন এই বাস্তবতাকে ধারণ করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে, যাতে মোট বাজেট ছোট করতে হয়েছে সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা আর উন্নয়ন বাজেট দুই লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকা।

প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয়েছে ৬.৭৫ শতাংশ আর মূল্যস্ফীতি নামিয়ে আনা হবে ৬.৫ শতাংশে। রাজস্বপ্রাপ্তির বিবেচনায় কাপড় অনুযায়ী কোটের আকার ঠিক হয়েছে। অর্থনৈতিক বাস্তবতাকে মেনে বাজেট করা হয়েছে। করকাঠামোতে, করহার নির্ধারণে প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত। করকাঠামোর শেষ ধাপে করহার ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।

কর ধার্য শুরু হয়েছে প্রথম ধাপে তিন লাখ ৫০ হাজার এক টাকা থেকে ওপরে সাড়ে চার লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের ৫ শতাংশ হারে। এভাবে আয় অর্জনের শেষ ধাপে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত করহার। করছাড়ের আয় সাড়ে তিন লাখ টাকা। যেকোনো আয়ের ওপর কর ধার্য করা যায়। উন্নত সক্ষম দেশে কর ছাড়া আয় বলে কিছু নেই। যেকোনো আয় হোক, কিছু কর দিতেই হয়। এমনকি যারা সামাজিক সুরক্ষা পায়, তাদের নগণ্য আয় হলেও নিয়ম রক্ষায় কর দিতে হয়।

কর ছাড় না দেওয়া বা কমিয়ে আনার প্রস্তাব করা হয়েছে সম্মানিত সংসদ সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আনার ক্ষেত্রে। ওপর থেকে শুরু করায় এটিকে বলা যায় সাহসী উদ্যোগ। সাংবিধানিকভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সুযোগ পাওয়া প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার। সে কারণে শুরু থেকেই সংসদ সদস্যদের এই সুবিধা পাওয়ার সমালোচনা ছিল। এ ক্ষেত্রে গাড়ি আমদানিতে কর আরোপকে নাগরিক সমাজ স্বাগত জানাবে।

ভ্যাট সংগ্রহে প্রতিটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) চালু করার কথা মাননীয় অর্থমন্ত্রী পুনর্ব্যক্ত করেছেন, যা যথার্থ। অতীতে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, ৫০ হাজার ইএফডি ক্রয়ের আদেশও দেওয়া হয়েছিল, সেটি কেন কার্যকর হলো না, ভেতর থেকে কারা প্রতিরোধ করেছিল, সেটির বিচার বিশ্লেষণ প্রয়োজন। নতুবা এই কাম্য উদ্যোগ আবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে পারে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কেন্দ্রীয় সার্ভারের সঙ্গে যুক্ত ইএফডি প্রতিটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে চালু হলে এই খাতে ভ্যাট আয় কয়েক গুণ বেড়ে যাবে। কর ফাঁকি বন্ধ হবে। করদাতাকে ট্যাক্স বিবরণী স্বতঃপ্রণোদিত অনলাইনে জমা দেওয়াকে উৎসাহিত করা হবে। সে জন্য কর হিসাব করার বিধি-বিধান সহজবোধ্য ও স্বব্যাখ্যাত ফরম প্রণয়ন করতে হবে। করদাতা ও কর ইন্সপেক্টরের সম্পর্ক যত বেশি নৈর্ব্যক্তিক থাকবে, ততই কর আহরণ পদ্ধতি সহজতর হবে এবং করদাতা কম নিপীড়নের শিকার হবেন। এই দিকনির্দেশনা প্রশংসনীয়, এর ব্যাপক প্রসার কাম্য। আরেকটি উদ্ভাবনীমূলক পদক্ষেপ প্রশংসার দাবি রাখে, সেটি হলো সব ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, যারা আয়কর রিটার্ন জমা দেয়, তাদের আয়কর রিটার্ন সনদের কপি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দৃশ্যমানভাবে ঝুলিয়ে রাখতে হবে। এতে করজাল বিস্তৃত হবে, সন্দেহ নেই।

বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে এই সময়ের অর্থনীতি ব্যবস্থাপনার সঠিক কৌশল হিসেবে। এটি এখন স্পষ্ট যে আমাদের মূল্যস্ফীতি উৎপাদন খরচ তাড়িত। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে কৃষিপণ্য, শিল্পপণ্য ও সেবা খাতে তৈরি পণ্য বা সেবার সরবরাহ বাড়াতে হবে, সেই সঙ্গে উৎপাদন খরচ কমিয়ে আনার প্রচেষ্টা নিতে হবে। কৃষি ও শিল্পে যেসব উৎপাদন উপকরণ আমদানি করতে হয়, সেসব পণ্যে আমদানি কর, নিয়ন্ত্রণমূলক কর শূন্য বা একেবারে সর্বনিম্নে নামিয়ে আনতে হবে। কৃষির সব ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হয়েছে। বোরো উৎপাদন অনেক ভালো হয়েছে। চালের দাম স্থিতিশীল আছে। খাদ্যপণ্য মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করবে আশা করা যায়। পণ্য সরবরাহ চেইনকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে, যেন কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপ এককভাবে মূল্য নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে। ঘাটতি পণ্যে আমদানি যেন সহজ ও দ্রুত হতে পারে, তা নিশ্চিত করতে হবে।

কর রাজস্ব আদায়ের প্রধান লক্ষ্য থাকবে উন্নয়নমুখী, কেবল যেকোনোভাবে রাজস্ব আয় বাড়ানো  নয়। কর রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস হবে আয়কর। ভ্যাট যেহেতু পরোক্ষ কর, ভোক্তার ওপর এর আপাতন সরাসরি, সে কারণে প্রয়োজনীয় ভোগ্য পণ্য ও ওষুধের ক্ষেত্রে ভ্যাট নিম্নহারে থাকবে, উচ্চধাপ ১৫ শতাংশ নয়। কর আরোপের যে দিকটি প্রশংসনীয় সেটি হলো আমদানি কর/সম্পূরক কর কমানোর ফলে দাম কমবে ল্যাপটপ, গুঁড়া দুধ, ডায়ালিসিসের কিছু যন্ত্রপাতি, ডেঙ্গুর পরীক্ষা কিট, গ্রিন টি, কফি, শুকনা ফলের মতো পণ্যের দাম কমবে। তবে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণকে যেহেতু মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উৎসাহিত করে থাকেন, সে কারণে ফলের রস, আমসত্ত্বের মতো পণ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট ধার্য করা সঠিক হয়নি। শিল্পায়ন প্রচেষ্টাকে আমাদের উৎসাহিত করতে হবে। তেমনি শিশুতোষ দুগ্ধজাত পুষ্টিপণ্য আইসক্রিমে (প্রক্রিয়াজাত পণ্য)  ১০ শতাংশ সম্পূরক কর আরোপ সঠিক হয়নি মনে করি।

বাস্তবতা হলো, আর্থিক টানাপড়েনের কারণেই বাজেট এবার ছোট আকারে করতে হয়েছে। বাজেট ঘাটতিও ৫ শতাংশের নিচে (৪.৬ শতাংশ জিডিপির) রাখার সদিচ্ছা ব্যক্ত হয়েছে। এ কারণেই গার্মেন্টসে প্রণোদনা অব্যাহত রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত, চার দশকের পরিণত প্রতিষ্ঠিত খাত এটি, বন্ডেড ওয়্যারহাউসের মাধ্যমে আমদানি করবিহীন উৎপাদন উপকরণ আমদানির সুযোগ পায় এই খাত। সর্বোপরি সাম্প্রতিককালের টাকার প্রায় ৪০ শতাংশ অবমূল্যায়নের সবটুকু আর্থিক সুবিধা পেয়েছে রপ্তানি খাত। এমনিতেই ২০২৬-এর পর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার শর্ত মোতাবেক কোনো রপ্তানি পণ্যে প্রণোদনা বা ভর্তুকি দেওয়ার সুযোগ রহিত হয়ে যাবে। সে কারণে গার্মেন্টস খাতে প্রদত্ত প্রণোদনা সহায়তা এই বাজেট সময়ে প্রত্যাহার শুরু করা যায়।

ব্যাংক খাতে সময়োত্তীর্ণ খেলাপি ঋণ বিপুল। ব্যাংকব্যবস্থা টালমাটাল হওয়ার অন্যতম কারণ এই খেলাপি ঋণ। পত্রপত্রিকার  প্রতিবেদন অনুযায়ী এই খেলাপি ঋণের বড় অংশ বাইরে পাচার হয়েছে। ধারণা করা হয়, আমাদের ডলার সংকটের অন্যতম কারণ দেশের টাকা বাইরে পাচার  হওয়া। অনাদায়ি খেলাপি ঋণ, পতনোন্মুখ কিছু বেসরকারি ব্যাংক, চাপিয়ে দেওয়া মার্জার প্রচেষ্টা, বাংলাদেশ ব্যাংকের ১০১ মিলিয়ন ডলার বেহাত হওয়া এসবের কার্যকারণ, ব্যক্তি ও পদ্ধতির ব্যর্থতা চিহ্নিতকরণে অনুসন্ধান ও সুপারিশ প্রণয়নে ব্যাংক কমিশন গঠন করা যেতে পারে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তাঁর প্রথম বাজেট বক্তৃতায় ব্যাংক কমিশন গঠন করার প্রস্তাব রেখেছিলেন, যা আর পরে কার্যকর হয়নি। সত্য যে নীতি উদ্যোগ ও প্রয়োজনীয় সংস্কারের কথা এই বাজেট বক্তৃতায় তেমন উল্লেখ করা হয়নি। ব্যাংক কমিশন গঠন, এনবিআরকে রাজস্ব সংগ্রহের দায় ও পদ্ধতি নিরূপণের দায়িত্ব অর্পণ করে; অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগকে (আইআরডি) করনীতি প্রণয়ন, করহার নির্ধারণ, করসংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তিতে কর ন্যায়পাল নিয়োগের আইনগত কাঠামো তৈরির দায়িত্ব প্রদান করা যায়।

ঘাটতি অর্থায়নে বিদেশি ঋণ নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে ৯০ হাজার ৭০০ কোটি টাকা, যা গত বছরের বাজেটে প্রস্তাব ছিল এক লাখ দুই হাজার ৪৯০ কোটি টাকা। প্রায় ১১ হাজার ৭০০ কোটি টাকা এবার কম। এখনো বিদেশি ঋণ আমাদের দেশীয় ব্যাংকঋণের চেয়ে সস্তা, বাস্তবায়ন সময়াবদ্ধ ও ব্যয়ের ক্ষেত্রে জবাবদিহি বেশি।

দেশীয় ব্যাংকের ঋণ গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে এক লাখ ৩৭ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। আমাদের জন্য প্রতিশ্রুত বিদেশি ঋণ পাইপলাইনে আছে ৪৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। চাইলে দেশীয় ব্যাংকের ঋণের পরিমাণ কমিয়ে বাজেটে প্রকল্পে আরো বেশি বিদেশি ঋণ গ্রহণের সুযোগ নেওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে দেশীয় ব্যাংকে আমাদের বেসরকারি খাতের ক্রাউডিং আউট (ঋণপ্রাপ্তির সম্ভাবনা ক্ষীণ হওয়া) হওয়ার আশঙ্কা আর থাকে না। বিষয়টি বাজেটে এখনো বিবেচনার দাবি রাখে।

বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রাধান্য দিলেও  প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর প্রচেষ্টা জোরদার করতে হবে দেশের সম্পদ বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে। সুদের হার ১৪-১৫ শতাংশে উন্নীত হওয়ায় বেসরকারি খাতে নতুন বিনিয়োগ থেমে গেছে চড়া সুদের কারণে। ক্ষুদ্র, ছোট, মাঝারি শিল্প এই উচ্চসুদে ঋণ নিতে অপারগ। সুদের হার আর যেন বৃদ্ধি না পায় বা কমে আসে, সে প্রচেষ্টা নিতে হবে। নীতি সুদের হার কমানো যায় কি না ভাবতে হবে (যেহেতু আমাদের মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এর প্রভাব কম)।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাজেটের আকার ছোট হয়েছে, সেটি জনগণের ব্যাপক অংশ মেনে নিয়েছে, যে কারণে বিরোধী দল বড় প্রতিবাদ, বিক্ষোভ মিছিল  নিয়ে রাস্তায় নামার সুযোগ নিতে পারেনি।

সব শেষে বলব, পরিমিত এই বাজেট বাস্তবায়নে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। উন্নয়ন বাজেট ও মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন স্কিমগুলো যা নেওয়া হয়েছে, তা নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়িত হলে অর্থের অপচয় কমবে। সব মন্ত্রণালয়কে বরাদ্দ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। যথাসময়ে প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে তা কাঙ্ক্ষিত প্রবৃদ্ধি অর্জনে সহায়ক হবে। চ্যালেঞ্জিং এই সময়ে মন্ত্রণালয়গুলোতে প্রকল্প বাস্তবায়ন দক্ষতা বাড়ানোর প্রশাসনিক উদ্যোগ শুরুতেই গ্রহণ করতে হবে।

লেখক : অর্থনীতিবিদ, পরিকল্পনা কমিশনের সাবেক সদস্য ও সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat