×
  • প্রকাশিত : ২০২৪-০৬-০১
  • ৭৯ বার পঠিত
স্বশিক্ষিত চিত্রকর আবুল খায়ের তখন টগবগে তরুণ। মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রতিনিয়ত ঢাকায় আসেন। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন চিত্রপ্রদর্শনী দেখেন। বাসায় ফিরে রংতুলি নিয়ে ক্যানভাসে নিজেও আঁকার চর্চা করেন।

চালাতেন নানান নিরীক্ষা। একদিন নিজের আঁকা কিছু ছবি নিয়ে হাজির হলেন রাজধানীর এক পাঁচতারা হোটেলের আর্ট গ্যালারিতে। সেখানকার এক কর্মকর্তা প্রথমেই জানতে চাইলেন, চারুকলা থেকে কবে পাস করেছেন। চারুকলায় আদৌ পড়েননি শুনে সেই ভদ্রলোক সোজা না করে দিলেন।

তাঁরা নাকি চারুকলার ছাড়া অন্য কারো ছবি রাখেনই না। খায়ের তাঁর সঙ্গে নেওয়া ছবিগুলো অন্তত দেখার জন্য কাকুতিমিনতি করলেন। কিন্তু ‘না, দেখব না’, বলে তাঁকে বের করে দিলেন সেই কর্মকর্তা। আরেক দিন ধানমণ্ডির এক গ্যালারিতে নামজাদা এক শিল্পীর প্রদর্শনীতে গিয়েছিলেন।

তখনো আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়নি। খায়ের ঘুরে ঘুরে ছবিগুলো দেখছিলেন। এমন সময় যে শিল্পীর প্রদর্শনী, তিনি এসে খায়েরকে বললেন, ‘আপনি কি সাংবাদিক?’

—‘না’। আর কিছু না শুনেই খায়েরকে কার্যত ঘাড় ধরে বের করে দিলেন সেই শিল্পী। চোখের জল মুছতে মুছতে সেদিন গ্যালারি থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলেন খায়ের।

https://cdn.kalerkantho.com/public/news_images/share/photo/shares/1.Print/2024/06.June/01-06-2024/2/kalerkantho-ft-8a.jpgএই দুটি ঘটনা মনে খুব দাগ কেটেছিল আবুল খায়েরের। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, একদিন এমন একটা গ্যালারি বানাবেন, যেখানে আমজনতার অবাধ যাতায়াতের সুযোগ থাকবে। আর প্রতিষ্ঠান দেখে বিচার করা হবে না কোনো শিল্পীকে। সেটা ১৯৯৬ সালের কথা। মাঝখানে পার হয়ে গেছে ২৮ বছর। এত দিন পর স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাঁর। মুন্সীগঞ্জে নিজের বাড়িতে গড়ে তুলেছেন আর্ট গ্যালারি। অকাল প্রয়াত মেয়ের স্মৃতি বাঁচিয়ে রাখার উদ্দেশ্যে চিত্রশালার নাম রেখেছেন ‘তৃষা আর্ট গ্যালারি’।

গত ৯ মার্চ ঘটা করে তৃষা আর্ট গ্যালারির উদ্বোধন করেছেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হকসহ অন্যরা। চিত্রশালাটির অবস্থান মীরকাদিম পৌরসভার রামগোপালপুরে। চারতলা ভবনের তৃতীয় তলায় এক হাজার ২০০ বর্গফুটের গ্যালারি। নিচতলায় তৃষা স্মৃতি পাঠাগার এবং দোতলায় ছবি আঁকার স্টুডিও।

ছোটবেলা থেকেই আঁকাআঁকি

শিল্পী আবুল খায়েরের জন্ম মুন্সীগঞ্জের বিনোদপুরে, অত্যন্ত রক্ষণশীল এক পরিবারে। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ার পর বাবা হাজি পিয়ার মোহাম্মদ ভর্তি করে দেন সিরাজদিখানের মোস্তফাগঞ্জ কওমি মাদরাসায়। উদ্দেশ্য ছেলেকে মাওলানা বানাবেন। কিন্তু মাদরাসার বাঁধাধরা জীবনে হাঁপিয়ে ওঠেন দুরন্ত কিশোর আবুল খায়ের। একসময় পালিয়ে চলে আসেন। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার ওখানেই ইতি! 

স্কুলে পড়ার সময়ই বইয়ের ছবি দেখে আঁকতে চেষ্টা করতেন খায়ের। ক্যালিগ্রাফির মতো করে খাতায় নিজের নাম লিখতেন। তবে বেশি ভালো লাগত মানুষের মুখাবয়ব আঁঁকতে। তখন পরিচিত অনেকের ছবি এঁকে দিয়েছেন পেনসিল দিয়ে।

এক লড়াকু শিল্পীর চিত্রশালা

চিত্রকর্ম : মাইসোল, শিল্পী : আবুল খায়ের

ছবি আঁকায় আগ্রহ দেখে খায়েরের বড় ভাই তাঁকে ১৯৮৪ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে (বাফা) চিত্রাঙ্কনের কোর্সে ভর্তি করে দেন। ছয় বছরের কোর্স। খায়েরের আঁকা শেখা চলল বছর তিনেক। হঠাৎ তাঁর শিক্ষক আব্দুল লতিফ বিদেশে চলে গেলেন। ছবি আঁকা শেখারও ইতি ঘটল সেখানেই।

এক লড়াকু শিল্পীর চিত্রশালা

চিত্রকর্ম : ড্যান্স, শিল্পী : আবুল খায়ের

মন পড়ে রয় ছবিতে

পরিবারের চালকল ও ধানের চাতাল ছিল। পরে নিজে ধানের আড়ত দেন খায়ের। তবে লোক রেখে ব্যবসা চালিয়ে মন দিয়ে ছবি আঁকতেন। সকালে খবরের কাগজ হাতে নিয়েই আগে খুঁজতেন চিত্রপ্রদর্শনীর খবর। একটা সময় পর্যন্ত ঢাকার যেকোনো চিত্রপ্রদর্শনীর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন।

এক লড়াকু শিল্পীর চিত্রশালা

চিত্রকর্ম : ট্রানজিশনাল পালস, শিল্পী : আবুল খায়ের

প্রদর্শনীর পর বাবার হুমকি

নিজের আঁকা ৫০টি ছবি নিয়ে ১৯৮৯ সালে খায়েরের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় মুন্সীগঞ্জে। বছর দুয়েক পরে নারায়ণগঞ্জে আলী আহাম্মদ চুনকা পৌর মিলনায়তনে হয় দ্বিতীয় একক চিত্রপ্রদর্শনী। এভাবে শিল্পী হিসেবে আশপাশে পরিচিতি পেতে থাকেন। লোকে এসে খায়েরের বাবাকে বলত—‘আপনার পোলা তো আর্টিস্ট হইয়া গেল।’ কিন্তু এসব মোটেও পছন্দ করতেন না হাজি পিয়ার মোহাম্মদ। একদিন ছেলেকে বললেন, ‘তোর জন্য আমার মান-ইজ্জত সব শেষ। বানাইতে চাইলাম মাওলানা আর হইলি শিল্পী! তোরে ত্যাজ্য করব!’

বাবার হুমকিতে নিরস্ত হলেন না খায়ের। বরং ১৯৯৬ সালে বিয়ে করার পরের বছরই ধান-চালের ব্যবসা বাদ দিয়ে ছবি আঁকাকেই পেশা করে নিলেন খায়ের। চিত্রকলায় আগ্রহী স্ত্রী তানজিনা আফরিনের সায়ও ছিল তাতে।

কেন ছবি আঁকেন—এই প্রশ্নে খায়েরের খোলামেলা জবাব, ‘পেটের দায়ে। বলতে পারেন, আর কোনো কাজ ভালো পারি না তাই। কিন্তু সার্বিক কাজ পর্যালোচনা করলে শুধু অর্থ উপার্জনই মুখ্য—এ কথা কিন্তু আমার কট্টর বিরোধীরাও বলবেন না। আসলে যে বিষয়গুলো আমাকে কুরে কুরে খায়, যাতনা দেয়, মর্মাহত করে তা ভুলে থাকতে ছবি আঁকি।’

তেলরং, জলরং, অ্যাক্রিলিক, কোলাজ থেকে শুরু করে নানা মাধ্যমে প্রতিনিয়ত এঁকে চলেছেন আবুল খায়ের। ছবির ফ্রেমের কাজও নিজেই করেন।

এক লড়াকু শিল্পীর চিত্রশালা

চিত্রকর্ম : ডেসপারেট, শিল্পী : আবুল খায়ের

এখন ঢাকার বিভিন্ন গ্যালারিতে তাঁর ছবি

এ পর্যন্ত পাঁচটি একক চিত্রপ্রদর্শনী হয়েছে খায়েরের। শিল্পকলা একাডেমি আয়োজিত এশিয়ান আর্ট বিয়েনালসহ অনেক প্রদর্শনীতে অংশ নিয়েছেন। এখন ঢাকার অনেক গ্যালারিতে শোভা পাচ্ছে খায়েরের চিত্রকর্ম। তাঁর ছবি প্রদর্শিত হয়েছে ইতালি ও জাপানেও। ২০১৪ সালে জাপান সরকারের আমন্ত্রণে দেশটি ঘুরে এসেছেন। এই শিল্পযাত্রায় সহযোগী হতে পেরে দারুণ আনন্দিত খায়েরের স্ত্রী তানজিনও। স্বামীর অনুপস্থিতিতে চিত্রশালার দেখভালও করেন তিনি।

এক লড়াকু শিল্পীর চিত্রশালা

চিত্রকর্ম : বাউল, শিল্পী : আবুল খায়ের

১৯৮৮ সালে বুলবুল ললিতকলা একাডেমি আয়োজিত বার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে প্রথম পুরস্কার পেয়েছিলেন খায়ের। ২০০২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ২৭তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ আয়োজিত চিত্রকর্ম প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীতে সম্মানসূচক পুরস্কার পেয়েছেন।

এক লড়াকু শিল্পীর চিত্রশালা

শিল্পী : আবুল খায়ের

কী আঁকেন খায়ের

বিমূর্ত ঘরানায় কিছু কাজ করলেও মোটের ওপর আবুল খায়েরের চিত্রভাষা সহজ। নিরন্তর সাধারণ মানুষের নৈমিত্তিক সংগ্রাম, দুরন্ত শৈশবের উচ্ছ্বাস, বাউল-ফকিরদের জীবনাচরণ এঁকে চলেছেন। মুক্তিযুদ্ধে বিদেশি বন্ধুদের অবদান নিয়ে করেছেন এক ব্যতিক্রমধর্মী কাজ।

আবুল খায়েরের চিত্রকর্ম প্রসঙ্গে বিশিষ্ট শিল্পী আব্দুস শাকুর শাহ বললেন, ‘শুরুতে অন্যদের প্রভাব থাকলেও এখন খায়েরের নিজের চিত্রভাষা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে জনজীবনের ছবি আঁকায় তাঁর মুনশিয়ানা আছে। তাঁর রং, কম্পোজিশন, গ্রাফের কাজ খুব ভালো। চারুকলার বাইরে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য শিল্পীর একজন খায়ের।’

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat