মে মাস পালিত হয় আন্তর্জাতিক মাসিক সচেতনতা মাস হিসেবে। আর ২৮ মে হলো মেন্সট্রুয়াল হাইজিন ডে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয় অনেক মেয়ে লুকিয়ে রাখেন। পাছে লোকে জেনে যাবে বলে প্রকাশ করতে চান না। নারীদের জন্য মাসিক বা পিরিয়ড খুবই স্বাভাবিক একটি শরীরবৃত্তীয় কাজ। কিন্তু নারীরা এ সময় কিছু বুঝে ওঠার আগেই গুটিয়ে যান। শত সমস্যায়ও ডাক্তারের কাছে যেতে দ্বিধাবোধ করেন।
পিরিয়ডের সময় অসাবধানতাবশত কোনো সমস্যা হলে বা হরমোনের কারণে মেজাজ খিটখিটে হলে ছেলেরা ঠাট্টা বা মজা করে বলে ‘ওর মনে হয় বিশেষ দিন’। অথচ ছোটবেলা থেকেই যদি এই বিষয়ে বুঝিয়ে দেওয়া হতো, তাহলে মেয়েদের এই বিষয়ে সংকোচে পড়তে হতো না। আর ছেলেরাও বুঝতে পারত, মাসিক বা পিরিয়ড কেবলই মেয়েলি লজ্জার ব্যাপার নয়।
মা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবেমা ও শিশুর সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে
কীভাবে বয়ঃসন্ধিকালের ছেলেমেয়েকে বুঝিয়ে বললে তারা মাসিককে স্বাভাবিক হিসেবে দেখবে তা নিয়ে ভেবেছি অনেকদিন। সহজে বুঝিয়ে বলা যায় কীভাবে? ইউটিউব বা গুগল থেকে অনেক কিছু পাওয়া যায়, যার বেশিরভাগই কঠিন কঠিন বায়োলজিক্যাল টার্মে লেখা বা বর্ণনা করা। কিন্তু তা দেখে কি একজন মা খুব সহজে তার ছেলে বা মেয়েকে বা বড়বোন ছোটবোন বা ভাইকে বুঝিয়ে বলতে পারেন না।
এখানে বোঝা দরকার, কেন মেয়েদের মাসিক হয়! মেয়েদের মাসিক হয়, কারণ এই পৃথিবীতে সে যেন আরেকটা প্রাণ আনতে পারে। প্রক্রিয়াটা সহজ করে বললে বোঝা যাবে, মেয়েদের মাসিক হওয়াটা আসলে কতটা জরুরি। ছেলে–মেয়ে, দেশ–সমাজভেদে সব জায়গায় কমবেশি সবাইকে বোঝানো হয়, মাসিক বা পিরিয়ডের সময় যে রক্ত বের হয় তা হলো দূষিত রক্ত। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক এর উলটো। একটা মেয়ে যখন জন্মগ্রহণ করে তখনই সে ৮-১০ লাখ ডিম্বাণু (অতিক্ষুদ্র বলেই ডিম না বলে ডিম্বাণু বলে) নিয়েই জন্মগ্রহণ করে। তার বয়স যত বাড়ে, তার শরীর থেকে তা বের হয়ে যেতে শুরু করে। তখন কিন্তু তার রক্তপাত হয় না। প্রথম পিরিয়ডের আগেই তার শরীর থেকে প্রতি মাসে প্রায় ১০ হাজার করে ডিম্বাণু বেরিয়ে যায়। সে যখন বয়:সন্ধিতে পৌঁছায় এবং প্রথম মাসিক হয় তখন তার শরীরে থাকে কেবল ৩-৪ লাখ ডিম্বাণু।
নিরাপদ মাতৃত্ব প্রতিটি নারীর অধিকারনিরাপদ মাতৃত্ব প্রতিটি নারীর অধিকার
তাহলে কখন ডিম বেরিয়ে গেলে তাকে আমরা মাসিক বলবো? একটা মেয়ের যখন প্রথম মাসিক হয়, তখন তার শরীরের সবচেয়ে ভালো ডিম্বাণুটা বেরিয়ে যায়। অসংখ্য ডিমের মধ্য থেকে একটা ডিম্বাণুই জরায়ুতে ভ্রূণ হওয়ার অপেক্ষায় থাকে। একটা নির্দিষ্ট সময় পরও যখন সে ভ্রূণ হতে না পারে, তখন সে শরীর থেকে বের হয়ে আসতে চায়। ওদিকে আমাদের শরীরের সবচেয়ে বিশুদ্ধ আর পুষ্টিকর রক্ত জরায়ুতে গিয়ে তার ভেতরে একটা আবরণ তৈরি করতে থাকে। যদি ভ্রূণ হয় তাহলে সে যেন তাকে আগলে রাখতে পারে, তাকে পুষ্টি দিতে পারে।
যদি ভ্রূণ তৈরি না হয় তাহলে সেই আবরণ ভেঙেই ডিমটা বেরিয়ে আসে বলে রক্তপাত হয়। সেই রক্তই হলো মাসিক। যেহেতু রক্তের দেয়াল ভেঙে বেরিয়ে আসছে ডিম্বাণু, রক্তপাত তো হবেই, তাই না? মাসিকের রক্তে কিন্তু কেবল ডিমই থাকে না, থাকে সেই রক্তের দেয়ালও। আর রক্ত ৫ থেকে ৬ দিন ধরে একটু একটু করে বেরিয়ে আসে। আমি একজনের ভিডিওতে দেখেছি, তিনি বলছেন, আমাদের শরীরের সবচেয়ে বিশুদ্ধ রক্তটা বের হয়ে যায় পিরিয়ডের সময়। কারণ এই দেয়াল কিন্তু কেবল বাচ্চা ধরেই রাখে না, রক্তের এই দেয়াল থেকেই বাচ্চা পুষ্টি পায় নয় মাস ধরে। আর একটু একটু করে বড় হয়। গর্ভকালীন নয় মাস তো মেয়েদের মাসিক হয় না। কেন হয় না? কারণ এই নয় মাসে পরিপুষ্ট রক্ত আস্তে আস্তে দেয়ালটাকে আরও মজবুত করে, যাতে বাচ্চাটা মায়ের পেটে সাঁতার কাটতে পারে, খেলতে পারে, হাত-পা ছুঁড়তে পারে।
কেমন হবে গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাসের খাবার?কেমন হবে গর্ভাবস্থার প্রথম ৩ মাসের খাবার?
প্রতিটা মানুষের চেহারা, হাত-পা, চুল যেমন আলাদা আলাদা দেখতে, তেমনি প্রতিটা মেয়ের প্রজনন অঙ্গের কাঠামো এক এক রকম। আমরা মেয়েরা আমাদের মুখমণ্ডলের সৌন্দর্য বা শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে যতটা সচেতন, ঠিক ততটুকুই অসচেতন এবং অজ্ঞ আমাদের প্রজনন স্বাস্থ্য নিয়ে।
এবারের মেন্সট্রুয়াল হাইজিন মাসে আসুন আমরা নারীরা আমাদের এই অঙ্গ সম্পর্কে জানি। ‘মাসিক কেন হয়’, সেটা জানি। আর শিখি কীভাবে ঠিকঠাক নিরাপদ মাসিক বা পিরিয়ডের ব্যবস্থাপনা করতে হয়।
তথ্যসুত্র: ক্রাইয়োস, জনস হপকিন্স মেডিসিন
লেখক: কমিউনিকেশন ম্যানেজার, সেন্টার ফর ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ (সিআইপিআরবি)
এ জাতীয় আরো খবর..