হঠাৎ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির যৌক্তিকতা নিয়ে সবার মনেই প্রশ্ন উঠেছে। তবে নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়নি, সেটিও সবার কাছেই অনুমেয়। অনেকেই বলছেন যত দিন সম্ভব ছিল, তত দিন আওয়ামী লীগ সরকার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির চিন্তা করেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্ববাজারে বিভিন্ন ধরনের জ্বালানির সরবরাহ মারাত্মকভাবে কমে যাওয়া, পাশের দেশে তেলের দাম বেশি থাকার কারণে বর্ডার অতিক্রমের আশঙ্কা এবং আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় অনেকটাই বাধ্য হয়ে বর্তমান সরকারকে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করতে হয়েছে।
বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সরকারি তথ্যের বরাত দিয়ে এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যে জানানো হয়েছে, সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন গত ছয় মাসে (ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই ২০২২) জ্বালানি তেল বিক্রিতে আট হাজার ১৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে, যা বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকটময় বাস্তবতায় অনেকটা অসম্ভব। পাশাপাশি সরকারের একাধিক মন্ত্রী এবং দায়িত্বশীল মহল থেকে এটি বলা হচ্ছে, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যখন স্থিতিশীলভাবে কমবে, তখন দেশের ভোক্তারাও কম দামে জ্বালানি তেল ক্রয় ও ব্যবহার করতে পারবে। আমরা যদি বিদ্যুৎ খাতে বাংলাদেশের সক্ষমতা ও অগ্রযাত্রাকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে এটি সহজেই প্রতীয়মান যে বিদ্যুৎ খাতে বর্তমান সরকারের সফলতা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অনবদ্য উদাহরণ তৈরি করেছে। মূলত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে আজকে বাংলাদেশের মানুষের জীবনযাত্রায় ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়েছে বিদ্যুৎ খাতে সরকারের বড় ধরনের অর্জনের কারণে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গেই পাওয়ার সেক্টরের উন্নয়নে দূরদর্শী ও কার্যকর ‘মাস্টারপ্ল্যান ২০১০’ গ্রহণ করে এবং সেটি যথাযথ বাস্তবায়নের ফলে তৎকালীন পাঁচ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতাকে বর্তমান সরকার প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত করতে পেরেছে। যেখানে ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ৪৫ শতাংশ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতাধীন ছিল, সেখানে মাত্র এক যুগের ব্যবধানে আজকে বাংলাদেশের শতভাগ মানুষ বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় এসেছে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ যখন ক্ষমতায় আসে, তখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা ছিল মাত্র এক হাজার ৬০০ মেগাওয়াট এবং ২০০১ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে তা তিন হাজার ৮০৩ মেগাওয়াটে উত্তীর্ণ হয়। বিস্ময়কর হলেও সত্য, ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আবার কমে যায়। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থেকে বিএনপি-জামায়াত সরকার যখন বিদায় নেয়, তখন বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা কমে দাঁড়ায় তিন হাজার ২৬৮ মেগাওয়াটে। বিদ্যুৎ খাত উন্নয়নে বর্তমান সরকারের সাফল্য তুলে ধরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রচারপত্র থেকে এসব তথ্য জানা যায়।
বর্তমান সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি এবং সার্বিক অর্থনৈতিক সাফল্যের কারণে বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়, যা বর্তমানে কিছুটা কমে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারে অবস্থান করছে এবং আমাদের রপ্তানি স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতো ৫০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করতে সক্ষম হয়। শহরের জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। কৃষি উৎপাদনে ব্যাপক সাফল্যের মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন সম্ভব হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বৃদ্ধি পেয়েছে, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু হ্রাস পেয়েছে এবং নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। মাথাপিছু আয় বর্তমানে প্রায় দুই হাজার ৮২৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে।
আমরা সবাই জানি, বিভিন্ন কারণে সৃষ্ট বৈশ্বিক সংকটের ফলে বর্তমান বিশ্ব অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে, যে কারণে অনেক দেশের অর্থনীতিতে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে। জ্বালানিসংকটের কারণে অনেক দেশ এনার্জি ইমার্জেন্সি ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে। বিশেষ করে করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ অর্থনৈতিক সংকট আরো ঘনীভূত করেছে। সৃষ্ট নতুন নতুন বৈশ্বিক সংকটের ফলে জ্বালানি তেলের দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। ভবিষ্যতে জ্বালানির দাম আরো বাড়বে বলে বিশেষজ্ঞরা ইঙ্গিত দিচ্ছেন। জ্বালানি পণ্যের এই বেপরোয়া ঊর্ধ্বগতির কারণে পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ জ্বালানি সাশ্রয় নীতি গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে। অনেক দেশ এই সংকট মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে।
সুতরাং এটি বললে অত্যুক্তি হবে না যে সরকার জ্বালানি সাশ্রয় নীতি গ্রহণ করেছে বৈশ্বিক সংকট মোকাবেলার পাশাপাশি এনার্জি সিকিউরিটি নিশ্চিত করার প্রয়োজনে, যেটি নাগরিকদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তাকে সুসংহত করছে এবং করবে। সাময়িকভাবে আমাদের কষ্ট হলেও দেশের বৃহৎ স্বার্থে আমাদের উচিত সরকারকে এ ক্ষেত্রে সহায়তা করা এবং জ্বালানিসাশ্রয়ী হওয়া।
আমাদের অনেকেরই মনে থাকতে পারে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় বিদ্যুতের দাবিতে আন্দোলনরত মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সেখান থেকে বর্তমান সরকার একটি সাফল্যজনক অধ্যায়ের সূচনা করেছে এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়েছে। আজ ভবিষ্যৎ জ্বালানি সাশ্রয় নীতির মাধ্যমে সেই অভিযাত্রাকে বেগবান করতে হবে এবং এই অগ্রযাত্রাকে নিশ্চিত করার মাধ্যমে ভবিষ্যতে আবারও জ্বালানি ও বিদ্যুতের সম্ভার ও সক্ষমতাকে এগিয়ে নিতে হবে।
আমরা যদি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষণের দিকে তাকাই, তাহলে আমরা দেখব বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞগোষ্ঠী মনে করে, বাংলাদেশ বৈশ্বিক সংকটের এই সময়েও পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় ভালো আছে। বলছে, এই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জ্বালানি ব্যবস্থাপনা, রিজার্ভ ব্যবস্থাপনা, সার্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা অনেক দেশের চেয়ে ভালো। সম্প্রতি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত পত্রিকা নিক্কিই তার এক প্রতিবেদনে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে বলা হয়, বৈশ্বিক চলমান মন্দার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যথেষ্ট ইতিবাচক রয়েছে। সম্প্রতি ফিন্যানশিয়াল টাইমসের সাবেক দক্ষিণ এশিয়া সম্পাদক ডেভিড পিলিং লিখেছেন, নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেও বাংলাদেশের অর্থনীতি শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছে এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়নে পর্যাপ্ত ব্যয়ের সক্ষমতা অর্জন করেছে।
সম্প্রতি নিউ ইয়র্কভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ইউক্রেন-রাশিয়া কনফ্লিক্টের পরে বিশ্ববাজারে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উপাদান প্রাকৃতিক গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় বেশির ভাগ দেশে সংকট সৃষ্টি হয়েছে। এতে এশিয়ায়ও এলএনজির বাজারমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। জ্বালানির ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে বিভিন্ন দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ জ্বালানি সাশ্রয় নীতি গ্রহণ করেছে। বিদ্যুৎ সাশ্রয়, আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং ডলারের রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় কার্যকর পদক্ষেপ অনুসরণ করে আগামী দিনে বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রাকে ভিন্ন উচ্চতায় উন্নীত করতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। সচেতন নাগরিক ও বিশ্লেষক হিসেবে আমরা মনে করি, বর্তমান সরকার আমাদের সামনে যে উন্নয়নের রূপকল্প তুলে ধরেছেন তার অগ্রযাত্রা অপ্রতিরোধ্য থাকা প্রয়োজন। বিশেষ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত দেশের কাতারে নেওয়ার যে ঘোষণা দিয়েছেন এবং কর্মসূচি গ্রহণ করেছেন, তা এ দেশের প্রত্যেক মানুষকে আশান্বিত করেছে। দেশের মানুষ একদিন উন্নত দেশের মানুষের মতো জীবন পাবে—এই প্রত্যাশাকে যদি আমরা অর্জন করতে চাই, তাহলে বর্তমান সরকারের অগ্রযাত্রা নিশ্চিত করতে হবে। এ ব্যাপারে নতুন প্রজন্মকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে এবং যারা তথ্যবিভ্রাট করছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের জ্ঞানভিত্তিক বিশ্লেষণ তুলে ধরতে হবে।
সময়ের সাহসী সিদ্ধান্ত নিয়ে বর্তমান সরকার জ্বালানি সাশ্রয় নীতি গ্রহণ করেছে এবং অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও ভবিষ্যতের কথা ভেবে জ্বালানি তেলের মূল্য সমন্বয় করেছে এবং আরো কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। জ্বালানি সাশ্রয়ে গৃহীত নীতি বাস্তবায়নের জন্য যার যার জায়গা থেকে অবদান রাখা জরুরি বলেও আমরা বিশ্বাস করি। সচেতন নাগরিক হিসেবে সব ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ব্যাপারে আমরা সাশ্রয়ী হব এবং সচেতন থাকব।
লেখকদ্বয় : ডা. মো. হাবিবে মিল্লাত এমপি, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ পার্লামেন্টারি ফোরাম ফর হেলথ অ্যান্ড ওয়েলবিয়িং।
ড. মো. রফিকুল ইসলাম, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
এ জাতীয় আরো খবর..