ডিমের দাম বেশ বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছে ঢাকার সাভারের নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষ। অনেকের ডিম কেনা বন্ধ। জানা গেছে, খামার থেকে ভোক্তার হাতে ডিম পৌঁছাতে মাঝখানে কমপক্ষে তিনটি হাত বদল হয়। খামারি ও পাইকারি দোকানিদের তথ্য মতে, সাভার পৌর ডিম ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিদিনের বেঁধে দেওয়া দামে ডিম বিক্রি করেন খামারিরা।
শিল্পাঞ্চল সাভারে প্রায় ৩০ লাখ মানুষের বসবাস। এর মধ্যে কলকারখানার শ্রমিকই বেশি। তাঁদের দৈনন্দিন খাবারে আমিষের মূল ভরসা ডিম। চার-পাঁচ দিনের ব্যবধানে ধাঁ ধাঁ করে ডিমের দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁদের স্বল্প আয়ের টাকায় টান পড়েছে। ডিমের বদলে অনেকে ভাতের সঙ্গে স্রেফ আলুভর্তা খাচ্ছেন।
বুধবার আশুলিয়ার ডেণ্ডাবর পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় ডিমের বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন লাল বানু (৫০) নামের এক দিনমজুর। ডিম কিনতে গিয়ে তিনি হতাশ। এই প্রতিবেদককে লাল বানু বলেন, ‘দুই ডিমের দাম চায় ২৮ টাকা। কয়েক দিন ডিম না কিনে শুধু আলুভর্তা দিয়েই ভাত খাইছি। চলা খুব মুশকিলই, বাবা। ’
বাজার ঘুরে জানা যায়, খামার থেকে ভোক্তার হাতে ডিম পৌঁছাতে মাঝখানে কমপক্ষে তিনটি হাত বদল হয়। খামারি থেকে ডিম ব্যবসায়ী সমিতি। সমিতি থেকে পাইকারি বাজার। এরপর খুচরা দোকান হয়ে ভোক্তার হাতে। সাভার পৌর ডিম ব্যবসায়ী সমিতির প্রতিদিনের বেঁধে দেওয়া দামে ডিম বিক্রি করেন খামারিরা। খামারি ও পাইকারি দোকানিরা অভিযোগের আঙুল তুলেছেন সমিতির কর্মকাণ্ড নিয়ে।
সাভার বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন শাহজালাল মার্কেটে রয়েছে সাভার পৌর ডিম ব্যবসায়ী সমিতি। ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠার শুরুতে ১৩৫ জন সদস্য থাকলেও বর্তমানে আছেন প্রায় ২০ জন। ডিম সমিতির সদস্য বা আড়তদাররা খামারিদের শর্ত দিয়ে টাকা দাদন দেন। খামারিরা তাঁদের কাছেই ডিম বিক্রির করতে বাধ্য থাকেন। আবার আড়তদারদের কাছ থেকে বাকিতে ডিম নিয়ে ব্যাবসায়িক কৌশলে আটকা পড়েন পাইকারি দোকানিরা। ফলে সেসব পাইকারি দোকানিকে নির্দিষ্ট আড়তদারের কাছ থেকে ডিম নিতে হয়। এতে ডিম কেনাবেচার পুরো প্রক্রিয়ায় ডিম সমিতির নিয়ন্ত্রণ থাকে। সমিতির নির্ধারণ করা দামেই ডিম বিক্রি হয় সাভার, মানিকগঞ্জ, টাঙ্গাইল, গাজীপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায়। সাভারে এই সমিতির বাজারে সাভার এবং এর আশপাশের প্রায় ৪০০ খামারি ডিম বিক্রি করেন। তিন মাস আগেও সাভারে প্রতিদিন ১২ লাখ ডিম বিক্রির জন্য নিয়ে আসতেন খামারিরা। এখন আসে সাত থেকে আট লাখ। সাভারে চাহিদা রয়েছে প্রায় চার লাখ, বাকিগুলো চলে যায় অন্যান্য জেলায়।
আশুলিয়ার পল্লী বিদ্যুৎ বাজারের ডিমের পাইকারি দোকানি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘চার-পাঁচ দিনের ব্যবধানে ১০০ ডিমে প্রায় ২৫০ টাকা দাম বেড়েছে। বেশি দামে কেনা, বিক্রিও বেশি দামে। ১০০ ডিমে ২০ থেকে ২৫ টাকা লাভ করি। দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে আমাদের বা খামারিদের হাত নেই। খামারির সুযোগ থাকলে এক দিনে প্রতি পিস ১৫ টাকা করে দাম রাখতেন? দাম নির্ধারণ করে সমিতি। ’
আশুলিয়ার নলামে সৃষ্টি পোলট্রি খামারে প্রতিদিন গড়ে তিন হাজার ডিম উৎপাদিত হয়। খামারের মালিক শওকত হোসেন বলেন, ‘আমরা চাইলেও দাম নির্ধারণ করার কোনো সুযোগ নেই। মূলত নিয়ন্ত্রণ করে সমিতি। তাদের বেঁধে দেওয়া দামেই আমরা বিক্রি করতে বাধ্য। প্রতি রাতে তারা দাম জানায় আগামীকাল কত টাকা বিক্রি করব; কিন্তু তারা কত দামে বিক্রি করবে, সেটা জানায় না। এ ছাড়া মুরগির খাদ্যের দাম বস্তাপ্রতি ২০০ টাকা করে বেড়েছে। এখন ১০০ ডিম এক হাজার টাকায় বিক্রি করছি। এখন একটু লাভ হচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পণ্য পরিবহনেও খরচ বেড়েছে। অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। ’
খুচরা দোকানি আল আমিন হোসেন বলেন, ‘আমরা পাইকারি বাজারে যে দামে ডিম কিনি, তার চেয়ে প্রতি পিস হয়তো ৫০ পয়সা থেকে এক টাকা লাভে বিক্রি করি। ’
সাভার পৌর ডিম ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ওবায়দুল খান বলেন, ‘আগে খামারিরা কেউ ১০ টাকা বেশি, কেউ ১০ টাকা কমে বিক্রি করতেন। পরে আমরা চিন্তা করলাম, সবাই যেন ন্যায্য মূল্য পায়। তখন আমরা সাভার পৌর ডিম ব্যবসায়ী সমিতি গঠন করি। দেশের বিভিন্ন বাজারের দাম সংগ্রহ করে সমিতির সদস্যরা ভোটের মাধ্যমে দাম নির্ধারণ করি। দাম প্রতি রাতেই খামারিদের জানিয়ে দিই। সভায় মুরগির খাদ্যসহ খরচ ও চাহিদা বিবেচনা করে দাম নির্ধারণ করা হয়। ঢাকার তেজগাঁও সমিতির নির্ধারণ করা দরেই দেশের প্রায় অর্ধেক বাজারে সরবরাহ করা হয় ডিম। এর পরই আমাদের অবস্থান। ’ তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো সিন্ডিকেট করি না। কেউ এ ধরনের অভিযোগ করলে সেটা ভুল। ডিম বিক্রি করতে আসা খামারিদের কাছ থেকে ১০০ ডিমে ২৫ টাকা কমিশন নেয় সমিতি। এর মধ্যে গাড়িভাড়াও সমিতিকে দিতে হয়। এ ছাড়া কোনো খামারি সমিতির বাজারে না এসে সরাসরি বিক্রি করেন। সেখানে তো কোনো কমিশন নেই আমাদের। ’
হঠাৎ ডিমের দাম বাড়তি কেন? জবাবে ওবায়দুল খান বলেন, একসময় সাভারে ৪০০ থেকে ৫০০ ডিমের খামার থাকলেও বর্তমানে আছে ৫০টি। দেশে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে। খাদ্যের দাম বেশি, খামারে খরচ বেড়েছে। ডিম উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি। তাই ডিমের দাম বেড়েছে।
৭৯ প্রতিষ্ঠানকে তিন লাখ টাকা জরিমানা
নিজস্ব প্রতিবেদক জানান, ডিম ও মুরগির মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালাচ্ছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। গতকাল বৃহস্পতিবার ২৯টি টিম অভিযান চালিয়ে ৭৯টি প্রতিষ্ঠানকে দুই লাখ ৯৪ হাজার টাকা জরিমানা করে।
এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিকাশ চন্দ্র দাস কালের কণ্ঠকে বলেন, তাঁদের এই অভিযান অব্যাহত থাকবে।
রাজধানীর চার প্রতিষ্ঠানকে গতকাল ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। কারওয়ান বাজারে ডিম ও মুরগির পাইকারি ও খুচরা দোকানে তদারকিমূলক অভিযান পরিচালনার সময় এই জরিমানা করা হয়। হিমালয় ট্রেডার্স ডিমের আড়ত ও জনতা মামণি ডিমের আড়তকে ২০ হাজার করে ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। সততা মুরগির আড়তকে ২০ হাজার টাকা ও আলহাজ এন্টারপ্রাইজকে ১০ হাজার টাকাসহ চারটি প্রতিষ্ঠানকে সর্বমোট ৭০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
অভিযান পরিচালনা করেন ঢাকা জেলা কার্যালয়ের অফিসপ্রধান মো. আব্দুল জব্বার মণ্ডল ও প্রধান কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. হাসানুজ্জামান।
মৌলভীবাজার প্রতিনিধি জানান, মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের একাধিক দোকানকে জরিমানা করা হয়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মৌলভীবাজার জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আল-আমিন এই অভিযানে নেতৃত্ব দেন। তাঁর নেতৃত্বে র্যাব-৯ ফোর্সের সহযোগিতায় শ্রীমঙ্গল পৌর শহরের নতুনবাজার, পোস্ট অফিস রোডসহ বিভিন্ন জায়গায় নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের প্রতিষ্ঠান ও দোকানে অভিযান চালানো হয়।
কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, দুপুরে কুমিল্লা শহরের নিউ মার্কেট ও রাজগঞ্জ বাজার এলাকার ডিম ও ব্রয়লার মুরগির দোকানে তদারকি অভিযান চালিয়ে পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা জরিমানা করে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
এ জাতীয় আরো খবর..