সম্প্রতি ঢাকার উত্তরায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের গার্ডার চাপা পড়ে মানুষের মৃত্যুকে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার, পরামর্শক ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাসমূহের অবহেলা, উদাসীনতা ও গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড উল্লেখ করে বিবৃতি দিয়েছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।
আজ বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমাদের নগরসমূহের বাসযোগ্যতা নিয়ে বহুল আলোচনা আছে; কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আমাদের স্বাভাবিক জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য নগরে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা যেমন নেই, ঠিক তেমনি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহের আইনের শাসন ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ও অত্যাবশ্যকীয় উদ্যোগগুলো বহুলাংশে অনুপস্থিত। ফলে রাজপথে, ভবনে কিংবা নগরের যেকোনো স্থানে আমাদের নাগরিকদের বেঘোরে প্রাণ হারাতে হচ্ছে। ’
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সারা দেশেই অবকাঠামোগত বৃহৎ প্রকল্পসহ নানা ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে জননিরাপত্তা ও জনভোগান্তি নিয়ে ইতিপূর্বে বিভিন্ন ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটেছে, যাতে সাধারণ মানুষের জানমালের বিবিধ রকমের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।
প্রকল্প দলিল ও সরকারের নির্মাণসংশ্লিষ্ট বিদ্যমান আইনে নির্মাণকালীন নিরাপত্তাব্যবস্থা ও কমপ্লায়েন্স নিশ্চিতে করণীয়সমূহ সুনির্ধারিত থাকা সত্ত্বেও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সরকারি সংস্থাসমূহের প্রত্যেকেই এই ব্যাপারে দিনের পর দিন উদাসীনতা ও গাফিলতি দেখিয়ে যাচ্ছেন, যা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ঠিকাদারসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ও পেশাজীবীরা মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিতে এবং আইনের বিধান ও প্রকল্পের কার্যাদেশের শর্তাবলি যথাযথভাবে প্রতিপালনে দিনের পর দিন বেপরোয়া মনোভাব দেখিয়েই চলেছেন। এ ধরনের ঘটনাকে কোনোভাবেই দুর্ঘটনা বলার সুযোগ নেই বরং এসব বেপরোয়া ঘটনাসমূহ সুস্পষ্টভাবে গাফিলতি ও অবহেলাজনিত হত্যাকাণ্ড।
বিবৃতিতে বলা হয়, ইতিপূর্বে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রকল্পে গার্ডার পরে মানুষের মৃত্যুসহ বিভিন্ন ধরনের নির্মাণ নিরাপত্তাজনিত অবহেলার কারণে বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন। বিআরটি প্রকল্পেই গত বছরের শুরুতে ঘটে যাওয়া গার্ডার দুর্ঘটনাসমূহের বিষয়গুলো সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে প্রতিবিধান করলে এ ধরনের বেপরোয়া ঘটনায় সাধারণ মানুষের মৃত্যু এড়ানো যেত বলে মনে করে আইপিডি। এ ক্ষেত্রে গার্ডার দুর্ঘটনার দায় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি পরামর্শক প্রতিষ্ঠানসহ সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর, সেতু কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর কোনোভাবেই এড়াতে পারে না।
চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে ২০১২ সালে গার্ডার ধসে ১৩ জন মানুষের মৃত্যুর ঘটনার এক দশক পার হতে চললেও তার কোনো সুষ্ঠু বিচার হয়নি। আইপিডি মনে করে, উক্ত ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হলে বিআরটি প্রকল্পের অব্যবস্থাপনা ও গাফিলতিজনিত হত্যাকাণ্ড এড়ানো যেত। এভাবেই দিনের পর দিন রাষ্ট্র ও সরকার দায়মুক্তির যে সংস্কৃতি চালু করেছে, তার মাধ্যমেই ঠিকাদার কম্পানি, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে অবজ্ঞা করার সুযোগ অবলীলায় পেয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক উত্তরায় বিআরটির গার্ডারধসে প্রাণহানির ঘটনাতেও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ওপর পুরো দায়ের ভাগ দিয়ে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের দায়মুক্তির প্রচেষ্টা চলছে। এমনকি এত বড় হত্যাকাণ্ডের পরও জনপ্রতিনিধিসহ দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের প্রকল্পের কাজ সাময়িকভাবে বন্ধ রাখার নির্দেশনা সত্ত্বেও যথাযথ নির্মাণ নিরাপত্তা নিশ্চিত না করেই অত্যন্ত ঝূঁকিপূর্ণভাবে বিআরটি প্রকল্পের কাজ এখনো বিভিন্ন জায়গায় চলছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এত বড় ঘটনার পরও সংশ্লিষ্ট সকলের বোধোদয় হয়নি।
আইপিডি মনে করে, নির্মাণসংশ্লিষ্ট কোনো কাজে অবহেলাসৃষ্ট ঘটনাসমূহের সুস্পষ্ট তদন্তের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট সকলের গাফিলতি যথাযথভাবে চিহ্নিত করে আইনের যথাযথ প্রয়োগ না করা হলে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ একেবারেই অসম্ভব। এটা না করা গেলে সাধারণ জনগণ ও নির্মাণ শ্রমিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বিদ্যমান বাস্তবতায় সাধারণ জনগণ ও নির্মাণ শ্রমিকদের যথাযথ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আইপিডি কিছু সুপারিশ করছে।
যার মধ্যে রয়েছে গার্ডারধসে মৃত্যুর ঘটনায় যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে ঠিকাদার কম্পানি, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার সংশ্লিষ্ট দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা এবং এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে ভবিষ্যতে করণীয়সমূহ নির্ধারণ করা। সারা দেশের বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ, উন্নয়ন প্রকল্প ও নির্মাণকাজে সংঘটিত এ ধরনের ঘটনাসমূহের তদন্ত দ্রুত শেষ করে দোষীদের চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া এবং হতাহতদের যথাযথ ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা। নির্মাণ ও অবকাঠামো প্রকল্প যথাযথভাবে তদারকির জন্য প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সংস্থাসমূহের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করা। প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষ ও যথাযথ নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করতে ব্যর্থ ঠিকাদারদের কালো তালিকাভুক্তি এবং ভবিষ্যতে প্রকল্প কার্যাদেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন ঠিকাদারদের বিবেচনা করার জন্য প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিত করা। প্রকল্প এলাকায় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে স্থানীয় এলাকাবাসীকে সম্পৃক্ত করে প্রকল্প এলাকায় জননিরাপত্তা নিশ্চিতে প্রয়োজনীয় ‘নাগরিক জননিরাপত্তা কমিটি’ তৈরি করে সাধারণ জনগণ ও এলাকাবাসীর নিরাপত্তা এবং নিরাপদ বসবাস ও চলাচল নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা। আমাদের দেশে সকল ধরনের অবকাঠামো নির্মাণ, ভবন নির্মাণসহ সকল ধরনের নির্মাণ ও উন্নয়নকাজে বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি), নির্মাণ বিধিমালা ও আইনসমূহ এবং প্রকল্প সংশ্লিষ্ট শর্তাবলি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় নির্মাণ নিরাপত্তা, কাজের কমপ্লায়েন্স ও যথাযথ মান নিশ্চিত করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) মনে করে, আমাদের নগর এলাকাসহ সর্বত্র সাধারণ জনগণের জীবন ও চলাচলে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব, যাকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নেই। সারা দেশের বিভিন্ন অবকাঠামো, ভবন নির্মাণসহ সকল নির্মাণ ও উন্নয়নকাজে পর্যাপ্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা নিশ্চিত করার প্রয়োজনে নির্মাণসংশ্লিষ্ট ঠিকাদারদের যথাযথ তদারক করতে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থাসহ সংশ্লিষ্ট সকলের প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও সুশাসন নিশ্চিত করতে সরকারকে প্রয়োজনীয় উদ্যোগসমূহ অতি দ্রুত নেওয়ার জোর দাবি জানাচ্ছে আইপিডি।
এ জাতীয় আরো খবর..