সড়কে বাজার বসাতে সিটি করপোরেশন কিংবা সরকারের কোনো সংস্থা ইজারা কিংবা অনুমোদন দেয়নি। তার পরও সড়ক দখল করে বাজার বসানো হয়েছে। সেই বাজারে রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩০০ দোকান। ভাড়া ও নৈশপ্রহরীর বেতনের নামে এসব দোকান থেকে প্রতিদিন বিপুল অর্থ আদায় করছে একটি চক্র।
সড়ক এবং দুই পাশের ফুটপাতের বেশির ভাগ জায়গা দখল করে বসানো হয়েছে এসব দোকান। এতে প্রতিদিন সড়কে জ্যাম সৃষ্টি হয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এলাকাবাসীকে। একই সঙ্গে পথচারীরা পার হতে গিয়ে পড়ছে বিড়ম্বনায়। এই চিত্র রাজধানীর উত্তর ভাসানটেকের মাটিকাটা সড়কের। এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেতে উত্তর সিটি করপোরেশনকে বারবার জানালেও মুক্তি মেলেনি।
সরেজমিনে গত দুই দিন ওই এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, সড়ক ও ফুটপাত দখল করে বসানো বাজারের দোকান থেকে আদায় করা হচ্ছে মোটা অঙ্কের অর্থ। আর সড়ক ও ফুটপাত দখল করে মাছ, মাংস, সবজি, ফল, ফুসকা, ভ্রাম্যমাণ খাবারের দোকান, মসলাজাতীয় পণ্যের দোকান বসানোয় পথচারীরা চলাচল করতে গিয়ে বিড়ম্বনায় পড়ছে। আর ইজারা নেওয়া বাজারের মতো টোকেন বানিয়ে দোকানপ্রতি নৈশপ্রহরীর জন্য প্রতিদিন আদায় করা হচ্ছে ১০০ টাকা। দোকানভেদে ভাড়া বাবদ প্রতিদিন আদায় করা হয় ১০০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। যাদের সঙ্গে চুক্তি রয়েছে তাদের কাছ থেকে একসঙ্গে মাস শেষেও এই ভাড়া আদায় করা হয়। মাটিকাটা ব্যবসায়ী কমিটির নামে করা হচ্ছে এই অবৈধ বাণিজ্য। যার সভাপতি স্থানীয় বাসিন্দা ইমরান হোসেন খোকন।
সেখানকার দোকানিরা জানান, ওই সড়কে বাজার বসানোর বিনিময়ে প্রতিদিন বিভিন্নভাবে আদায় করা হয় লাখ টাকার বেশি। আবার সিটি করপোরেশনের অনুমোদনে যাদের বৈধ দোকান রয়েছে তাদের কেউ কেউ দোকানের সামনে ফুটপাতে বসানো দোকান থেকে নিজেরাই প্রতিদিন ভাড়ার নামে অর্থ আদায় করছে। একইভাবে ওই সড়কে কিছু বাড়ির মালিকও একই কাজ করছেন।
এই বাজারের সবজি বিক্রেতা রহমত আলী বলেন, ‘এটা সরকার অনুমোদিত বাজার নয়। সড়কে বসতে বসতে বাজার হয়ে গেছে। এখানে ব্যবসা করতে হলে কথিত বাজার কমিটিকে নির্দিষ্ট চাঁদা দিতে হয়। চাঁদা যারা নেন তাঁদের মধ্যে স্থানীয়সহ বিভিন্ন দলের লোকজনও আছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই বাজার দেখভালের জন্য রয়েছেন ছয়জন নৈশপ্রহরী। তাঁদের প্রত্যেকের মাসিক বেতন ১০ হাজার টাকা। আর প্রতিদিন চাঁদা তুলে যাঁর কাছে জমা দেওয়া হয় তাঁকে মাসে বেতন দেওয়া হয় ১৫ হাজার টাকা। তবে প্রতি মাসে ওই বাজার থেকে ভাড়া ও বেতনের নামে তুলে নেওয়া হয় অন্তত ৩০ লাখ টাকা।
নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একজন ফল বিক্রেতা বলেন, ‘বাড়ির সামনের সড়কে বসি বলে চার বছর ধরে বাড়িওয়ালাকে ভাড়া দিচ্ছি। আবার বাজার কমিটিকেও দিতে হয়। না হলে তারা উঠিয়ে দেবে। সব মিলিয়ে আমার এই ছোট্ট দোকান থেকে মাসে ভাড়া ও চাঁদা বাবদ আট হাজার টাকার বেশি দিতে হচ্ছে। ’
জানতে চাইলে মাটিকাটা এলাকার বাসিন্দা সেকান্দর আলী ও আবদুর রহমান জানান, ফুটপাত ও সড়ক দখল করে বাজার বসানোয় এলাকাবাসীর চলাচল করতে খুব সমস্যা হচ্ছে। বিশেষ করে শিশু-বৃদ্ধ, নারী এবং শিক্ষার্থীদের বাজারের ভিড় টেলে রাস্তা পার হতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয়। তাঁরা চান বাজার উচ্ছেদ করে সড়কটি দখলমুক্ত হোক।
বাজারটি উচ্ছেদে গত বছরের ২৬ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচবার এলাকাবাসীর পক্ষে অন্তত দুজন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, মিরপুর-২-এর আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে অভিযোগপত্র দিয়েছেন; কিন্তু এখন এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
অভিযোগপত্রে উল্লেখ করা হয়, মাটিকাটা এলাকার প্রধান সড়কে ও ফুটপাতে এলাকার চাঁদাবাজ কসমেটিক মিজান ও মোল্লা খোকন গং ভুয়া ব্যবসায়ী সমিতির নামে দোকান বসিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আদায় করছে।
একজন অভিযোগকারী বলেন, ‘ চাই আমরা এই অবৈধ বাজার এবং চাঁদাবাজি বন্ধ হোক। এ পরিস্থিতির কারণে এলাকার মানুষদের প্রতিদিন ভোগান্তি পোহাতে হবে, এটা দুঃখজনক। আমরা প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি, তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। ’
দোকান থেকে টাকা আদায়কারী আকরাম বলেন, ‘গত মাস পর্যন্ত আমি আদায় করেছি। তবে এ মাসে অন্যজন আদায় করছে। আমরা এই টাকা আদায় করি দারোয়ান ও পরিচ্ছন্নতাকারীদের জন্য। আর কিছু টাকা জমলে সেটা মানবিক কাজে ব্যয় করা হয়। ’
মিজানুর রহমান মিজান (কসমেটিক মিজান) চাঁদা আদায়ের কথা অস্বীকার করে বলেন, ‘চাঁদা আদায়ের বিষয়ে আমি কিছু বলতে পারব না। সমিতির সঙ্গে আগে জড়িত ছিলাম, এখন নেই। বর্তমানের এটা মালিক সমিতি বলতে পারবে। ’
কথিত ব্যবসায়ী কমিটির সভাপতি ইমরান হোসেন খোকন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দোকানদারদের কাছ থেকে রাতে পাহারা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বাবদ কেউ কিছু টাকা নিলে নিতে পারে। এ বিষয়ে আমি সঠিক জানি না। এটি অনুমোদিত কোনো বাজার না, রাস্তায় বসানো বাজার। এলাকার লোকজন চালায়। এতে সকাল থেকে রাত পর্যন্ত জনসাধারণের চলাচলে ভোগান্তি হয় এটা সত্য। এ বিষয়ে শিগগিরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
ক্যান্টনমেন্ট থানার ওসি কাজী সাহান হক বলেন, ‘টোকেনের নামে চাঁদা আদায়ের বিষয়টি আমার জানা নেই। নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে দ্রুতই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। ’
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ক্যান্টনমেন্ট জোনের অতিরিক্ত কমিশনার (এডিসি) ইফতেখায়রুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ওই বাজার বাসানোর বিষয়ে ভুক্তভোগীরা যদি লিখিত অভিযোগ দেন অবশ্যই পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিষয়টি নিয়ে থানার সঙ্গে আলাপ করে দেখব। ’
এ জাতীয় আরো খবর..