ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতি মধ্যবিত্ত পরিবারকে ঋণগ্রস্ত করে তুলছে। এতে ক্রেডিট কার্ডের ঋণের রেকর্ড ছুঁইয়েছে। এ সময় অর্থ সাশ্রয় তো দূরের কথা, ভেঙে খাচ্ছে আগের জমানো সঞ্চয়ও। ফলে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ভাটা পড়েছে। আর নিম্নবিত্ত পরিবারের সদস্যদের মধ্যে এ সংকট আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে।
কারণ মূল্যস্ফীতি তাদের সবচেয়ে বেশি আঘাত করেছে। কিন্তু এসব পরিবারের নেই সঞ্চয়, যা দিয়ে এমন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে। পাশাপাশি তাদের ঋণ করারও রাস্তা নেই। এ অবস্থায় সমাজে ধনী ও গরিব মানুষের মধ্যে বড় ধরনের বৈষম্য সৃষ্টি হতে পারে-এমন আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদরা।
তাদের আরও অভিমত-ঋণ নেওয়ার পরিমাণ বাড়তে থাকা আর সঞ্চয় হ্রাস-এ ঘটনাই ইঙ্গিত দেয় যে জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে মানুষকে লড়াই করতে হচ্ছে।
ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে খরচের বোঝা সামলাতে পরিবারগুলো ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। এদিকে কোনো সুখবর দিতে পারেনি অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্টরা।
তাদের হিসাব, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে যে মূল্যস্ফীতি ঘটছে বা আরও ঘটবে সেটি সহনীয় পর্যায়ে আসতে অপেক্ষা করতে হবে কমপক্ষে আরও আট থেকে নয় মাস।
যদিও অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, গরিব মানুষের জন্য সরকার কাজ করছে। আশা করছি দুঃসময় কেটে যাবে। জনগণকে সহযোগিতা করা এবং তাদের ভালোভাবে রাখা সরকারের দায়িত্ব। সেই কাজটি সরকার করে যাচ্ছে এবং করে যাবে।
একটি দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সামগ্রিক মূল্যস্তরের ওপর নির্ভরশীল। দামস্তর ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকলে তখন ওই দেশে মূল্যস্ফীতি দেখা দেয়। মূল্যস্ফীতি বেশি হলে জনগণের সঞ্চয়ের পরিমাণ কমে যায়।
পরিস্থিতি সামলাতে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশেও মূল্যস্ফীতির হার ঊর্ধ্বমুখী। ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর ফলে বৈশ্বিক সংকটে মূল্যস্ফীতির হার ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা বিরাজ করছে।
ফেব্রুয়ারিতে যুদ্ধ শুরুর পর বিবিএসের হিসাব মতে, মার্চে গড় মূল্যস্ফীতি দাঁড়ায় ৭.৪২ শতাংশ (২০২১ সালে একই মাসে ছিল ৫.৪৭ শতাংশ), এপ্রিলে ৬.২৯ শতাংশ (আগের বছরে একই সময়ে ছিল ৫.৫৬ শতাংশ) এবং মে মাসে ৭.৪৫ শতাংশ (২০২১ মে-তে ছিল ৫.২৬ শতাংশ)।
এছাড়া জুন ও জুলাইতে পর্যায়ক্রমে মূল্যস্ফীতির হার উঠে ৭.৫৬ শতাংশ এবং ৭.৪৮ শতাংশ।
জিনিসপত্রের দাম কিছুটা বেড়েছে এটা সত্য, আমরা অস্বীকার করব না-এমন মন্তব্য করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। তিনি যুগান্তরকে বলেন, চাল ও ভোজ্যতেলের দাম কমে আসছে। সরকার চাল আমদানির অনুমতি দেওয়ায় স্থানীয় বাজারে এর প্রভাব পড়েছে।
যে কারণে মূল্যস্ফীতি জুলাইতে কমছে। ভবিষ্যতে আরও কমবে। তিনি আরও বলেন, নিম্ন আয়ের মানুষের বেশি ব্যবহৃত নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে আলাদা হিসাব করা হবে।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতি চলাকালীন চলতি বছরের মার্চ থেকে মে মাসে ক্রেডিট কার্ডধারীরা যে ঋণ গ্রহণ করেছেন সেটি আগের (২০২১ সাল) বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ হাজার ৪৮৪ কোটি টাকা বেশি।
অর্থাৎ স্বাভাবিক সময়ে ২০২১ সালের মার্চ থেকে মে এই সময় ক্রেডিট কার্ডে ঋণ করা হয় ৫ হাজার ১১৫ কোটি টাকা। কিন্তু ২০২২ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত এই সময়ে ঋণ করা হয়েছে ৭ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা।
বিশ্লেষণে আরও দেখা গেছে, ২০২২ সালের মার্চে ক্রেডিট কার্ড থেকে ঋণ নেওয়া হয় ২ হাজার ৫১৩ কোটি টাকা, গত বছর একই সময়ে ঋণ নেওয়া হয়েছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা।
টাকার অঙ্কে গত বছরের তুলনায় মূল্যস্ফীতিকালীন মার্চে পরিবারগুলো ৭৩০ কোটি টাকা বেশি ঋণ নিয়েছে। একইভাবে এপ্রিলে যেখানে ক্রেডিট কার্ড থেকে ঋণ নেওয়া হয় ২ হাজার ৭১৫ কোটি টাকা, পাশাপাশি এর আগের বছরের একই সময়ে ঋণ গ্রহণের অঙ্ক ছিল ১ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এপ্রিলে এসে মূল্যস্ফীতিকালীন ঋণ বেশি করেছে ১ হাজার ১৮১ কোটি টাকা। আর গেল মে মাসে ক্রেডিট কার্ডে ঋণ নেওয়ার পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৩৭১ কোটি টাকা, যা আগের বছরের একই সময়ে ছিল ১ হাজার ৭৯৮ কোটি টাকা।
অর্থাৎ এসময়ে ঋণ নেওয়া বেড়েছে ৫৭৩ কোটি টাকা। ঊর্ধ্বমুখী মূল্যস্ফীতির কারণে সঞ্চয় না থাকায় অনেকে ঋণ করে চলেছেন। যে কারণে ক্রেডিট কার্ড থেকে ঋণ নেওয়ার পরিমাণে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে।
মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের সঞ্চয় হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি উঠে আসে সঞ্চয়পত্র অধিদপ্তরের তথ্যে। সংস্থাটির হালনাগাদ তথ্যমতে, মূল্যস্ফীতি চলাকালীন মার্চ থেকে মে পর্যন্ত এ তিন মাসে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমেছে ৪ হাজার ৫০৫ কোটি টাকা।
২০২১ সালে যেখানে এই তিন মাসে সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছিল ৭ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। অথচ মূল্যস্ফীতির কারণে ২০২২ সালের একই সময়ে সঞ্চয়পত্র নিট বিক্রি হয়েছে ৩ হাজার ৪৭৯ কোটি টাকা।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২২ সালের মার্চে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয় ১ হাজার ৮২৫ কোটি টাকার, আগের বছরের একই সময়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৮৯১ কোটি টাকা।
অর্থাৎ মূল্যস্ফীতিকালীন মার্চে সঞ্চয়পত্র কম বিক্রি হয়েছে আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ২ হাজার ৬৬ কোটি টাকা।
একইভাবে গেল এপ্রিলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ১ হাজার ১৫ কোটি টাকা, যা আগের বছর একই সময়ে বিক্রি হয়েছিল ১ হাজার ৫২৬ কোটি টাকা, অর্থাৎ এপ্রিলে এসে সঞ্চয়পত্র বিক্রি তুলনামূলক কমেছে ৫১১ কোটি টাকা।
আর ২০২২ সালের মে মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রির পরিমাণ ৬৩৯ কোটি টাকা, যা আগের বছরে একই মাসে বিক্রি ছিল ২ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। গত মে মাসে সঞ্চয় কমেছে ১ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা।
অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেকে সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছেন। নতুন করে সঞ্চয় করতে পারেননি। যার প্রভাব পড়েছে সঞ্চয়পত্রের ওপর।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জানান, ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ার মানেই হচ্ছে সঞ্চয় কমেছে। আয়ের চেয়ে বেশি ব্যয় হচ্ছে, এ জন্য ঋণ করে চলছেন।
তিনি আরও বলেন, করোনার পরবর্তী অর্থনীতি চাঙ্গা হয়। ইদানীংকালে এমন কিছু ঘটেনি সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমবে। এতে বোঝা যায় মানুষের আয় কমেছে মূল্যস্ফীতির কারণে। আর মানুষ ঋণ করছে ঘাটতির কারণে। গত এক বছরে যা ঘটেছে মূল্যস্ফীতির কারণে।
ফলে সঞ্চয় কমে যাওয়া এবং ঋণ বৃদ্ধি পাওয়া দুটো সূচকই মূল্যস্ফীতির কারণে হয়েছে। তিনি আরও বলেন, এতে সমাজে ধনী ও দরিদ্র শ্রেণির মধ্যে আয়বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি যুগান্তরকে বলেন, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হ্রাস ও ক্রেডিট কার্ডের ঋণ বৃদ্ধি দুটো সূচকই মূল্যস্ফীতির কারণে ঘটেছে।
ক্রেডিট কার্ড ব্যবহারকারী এবং সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগকারী উভয় শ্রেণির অধিকাংশই মধ্যবিত্তের। মূল্যস্ফীতির কারণে এই শ্রেণির মানুষ সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছে এবং নতুন করে সঞ্চয় করতে পারেনি।
আবার পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে অনেকে ঋণও করেছেন। তাদের এ অবস্থা হলে নিম্ন আয়ের মানুষের ক্ষেত্রে এটি আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে।
কারণ মূল্যস্ফীতি সবচেয়ে বেশি আঘাত করে গরিব মানুষের ওপর। হয়তো তাদের সঞ্চয় করার মতো কোনো অর্থ নেই, ঋণ করার রাস্তাও নেই।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ : মূল্যস্ফীতি প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে অর্থ বিভাগের একটি সমীক্ষা করা হয়েছে।
সেখানে দেখা গেছে, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাবে। আর সেটি সহনীয় পর্যায়ে আসতে কমপক্ষে ৯ মাস লাগবে।
এরপরও মূল্যস্ফীতির হার ৬ শতাংশের উপরে থাকবে। তবে সেটি ৭ শতাংশ অতিক্রম করবে না। যদিও সরকার এ বছর মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে ৫ দশমিক ৫ শতাংশ।
এদিকে সংকোচনমূলক বাজেট ও মুদ্রানীতি নিয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করেছে সরকার। চলতি বাজেটে ব্যয়ের অনুপাত জিডিপির ১৫ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হয়।
এর আগের বাজেটের ব্যয়ের অনুপাত ছিল ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ। ডিসেম্বর পর্যন্ত যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছে সেখানে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৪ দশমিক ৭০ শতাংশ।
আগের মুদ্রানীতিতে ঋণ প্রবাহের হার ছিল ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ। বাজারে ঋণের অনুপাত টেনে অর্থ প্রবাহ কমিয়ে রাখা হয়। কিন্তু এসব উদ্যোগের পর এখন জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণে সব হিসাব-নিকাশ পালটে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যুক্তরাষ্ট্রে ক্রেডিট কার্ডে ঋণের রেকর্ড সৃষ্টি : এদিকে চলতি বছরের জুনে গত ১৭ বছরের মধ্যে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি অর্থ ঋণ নেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে।
ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বিবিসি। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে ঋণের পরিমাণ সাড়ে ১২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে; ২০০৫ সালের নভেম্বরের পর যা সর্বোচ্চ।
ব্যাংকের হিসাব থেকে আরও দেখা যাচ্ছে যে, মাসে সঞ্চয়ের জন্য গ্রাহকদের যে অর্থ বরাদ্দ ছিল সেখানেও কাটছাঁট করতে হয়েছে।
জ্বালানি এবং খাদ্যপণ্যের উচ্চমূল্যের কারণে দেশে মূল্যস্ফীতি ঊর্ধ্বমুখী বিরাজ করছে। এখন দ্রব্যমূল্য সবচেয়ে বেশি। দেশে মূল্যস্ফীতির বর্তমান হার ৯.৪ শতাংশ।
এ জাতীয় আরো খবর..