×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৭-৩১
  • ৭৩ বার পঠিত
দক্ষিণ মহারাষ্ট্রের সাংলিতে অহল্যাদেবি হোলকার সড়কে দুপুরে তেমন একটা ভিড় থাকে না। কিন্তু কাল দুপুর গড়িয়ে বিকেল নাগাদ এই সড়কের পাশে একটি চা ও পানের দোকানের সামনে লোকজনের ভিড় বেড়ে যায়। সংবাদমাধ্যমেরও দু-একজন চলে আসেন সেখানে। 

সবার চোখে দোকানের ১৪ ইঞ্চি ভিডিওকন টিভির পর্দায়। বার্মিংহামে কমনওয়েলথ গেমসে লড়ছে এ দোকানেরই ছেলে সঙ্কেত মহাদেব সরগর। টিভি পর্দায় সেঁটে থাকা চোখগুলো সহসাই উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ভারোত্তোলনে ছেলেদের ৫৫ কেজি ওজনশ্রেণিতে রুপার পদক জিতেছেন সঙ্কেত।

ডান হাতে চোট ছিল। হাতটা স্লিংয়ে বেঁধে বিজয় মঞ্চে ওঠেন সঙ্কেত। চোখেমুখে আঁধার। কী ব্যাপার! এবার কমনওয়েলথ গেমসে সঙ্কেতের কল্যাণে প্রথম পদকের দেখা পেয়েছে ভারত। ২১ বছর বয়সী ছেলেটি কোথায় আনন্দে ভেসে যাবেন, তা না, চোখেমুখে আঁধার। আসলে বাবাকে দেওয়া কথা রাখতে পারেননি সঙ্কেত। বার্মিংহামে রুপা জয়ের পর জানালেন সে কথা, ‘বাবার কাছে ওয়াদা করেছিলাম, সোনার পদক জিতব। রুপা জিতেছি, তবে বাবা এতেই খুশি।’

সঙ্কেতের বাবা মহাদেব আনন্দ সরগর এই চা ও পানের দোকানের মালিক। দোকানটি তিনিই পরিচালনা করেন। বাবার অনুপস্থিতিতে সঙ্কেত নিজেও দোকানদারি করেছেন। কিন্তু এখন ভাগ্যটা পাল্টাতে চান। ভারতের সংবাদমাধ্যম ‘টাইমস অব ইন্ডিয়া’ সঙ্কেত বলেছেন, ‘এই পদকে আশা করি আমার পরিবারের ভাগ্য পাল্টাবে। বাবাকে আর পানের দোকানে দেখতে চাই না।’

সোনার পদক জয়ের পথেই ছিলেন সঙ্কেত। কিন্তু ক্লিন অ্যান্ড জার্ক ইভেন্টে এসে দুবার ওজন তুলতে ব্যর্থ হন ডান হাতের চোটের জন্য। ওজন তোলার সময়ই চোট পান। রুপা জিতলেও সোনা জিততে না পারার আক্ষেপটা লুকাতে পারেননি সঙ্কেত। তাঁর ভাষায়, ‘বাবা বলেছেন, সোনা জিতলে বেশি ভালো হতো। তবে আমি খুশি। সোনায় ভাগ্য পাল্টায়, এটা বাবার কথা। পরিবার আমাকে প্রেরণা দিচ্ছে ঠিক, তবে সোনা তো সোনাই। পদক জয়ের পর অনেক অ্যাথলেটেরই তো ভাগ্য পাল্টায়। সরকার সাহায্য করে। আমিও নিজের পরিবারকে সাহায্য করতে চাই। বাবা দোকানদারি করুক, সেটা আমি আর চাই না। পরিবার আমার জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে। পদকটি তাঁদের উৎসর্গ করছি।’

সঙ্কেতের বাবা মহাদেব ৯০ দশকে সাংলি অঞ্চলে আসেন। শুরুতে ফেরি করে ফল বিক্রি করতেন। এরপর কিছু টাকা জমিয়ে পানের দোকান দেন। পরে দোকানটির পাশেই চা এবং সকালের নাশতার আরেকটি দোকান দেন মহাদেব। ২০০০ সালে জন্ম নেওয়া সঙ্কেতকে হাতে-পায়ে একটু বেড়ে ওঠার পর স্বাভাবিকভাবেই দোকানের কাজে সাহায্য করতে হয়েছে। সঙ্কেত জানালেন, ‘চা-টা আমাদের বিশেষ পানীয়। এর বাইরে আমি সাদা পান, মিঠা পান ও মাসালা পান—খুব অল্প বয়সেই বানানো শিখেছি।’

কিন্তু সঙ্কেতের বাবা মহাদেবের মনে অন্য কিছু ছিল। ছেলেকে তিনি পানের দোকানদার বানাতে চাননি। জীবনের যূপকাষ্ঠে পড়ে নিজের খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নটা পূরণ করতে পারেননি। তাই সঙ্কেত ১২ বছর বয়সে থাকতে তাকে একদিন নিয়ে যান দোকানের পাশেই অবস্থিত ভারোত্তোলনের একটি ট্রেনিং সেন্টারে। ব্যস, সেই যে শুরু!

অনুশীলনের প্রথম কয়েক বছর সঙ্কেত শুধু ওজন তুলেছেন। কী প্রতিযোগিতা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে এই প্রতিযোগিতা কীভাবে অনুষ্ঠিত হয়—সেসব বিষয়ে কোনো ধারণাই ছিল না তাঁর। খুব বেশি অনুশীলন ছাড়াই নবম শ্রেণিতে থাকতে বিভাগীয় পর্যায়ে ভালোত্তোলনে রুপা জেতেন সঙ্কেত।

সঙ্কেত তখন একটি বিষয় বুঝে যান। আরেকটু বেশি অনুশীলন করলে হয়তো সোনার পদকই জিততে পারতেন। বাবা তাঁকে বলেছিলেন, ‘আমি চাই না তুমি দোকানেই জীবনটা কাটিয়ে দাও। সবকিছু তোমারই হাতে।’ সঙ্কেত সেদিনই বুঝে যান, ‘নিজের সেরাটা ঢেলে না দিলে কখনো জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছাতে পারব না।’ 

কিন্তু কমনওয়েলথ গেমসের স্বপ্ন দেখা সঙ্কেতের জন্য তখনো অনেক দূরের পথ। আর পেশাদার অ্যাথলেট হিসেবে বেড়ে ওঠাও তাঁর জন্য সে সময় চ্যালেঞ্জিং ছিল। দোকানের কাজ দেখাশোনার সঙ্গে অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া সহজ ছিল না, ‘তখন বাবা কোনো কাজে দোকানে যেতে না পারলে আমি অনুশীলন শেষে দোকানে বসতাম। কাজটা কঠিন ছিল। কারণ, প্রতিদিনই হিসাব মেলাতে হতো এবং কর্মচারী থেকে সবকিছু দেখাশোনা করতে হতো।’ 

সঙ্কেতের বাবা মহাদেবের ভাষায়, ‘বেঁচে থাকতে হলে, সঙ্কেতের ক্যারিয়ার এগিয়ে নেওয়ার জন্য এ ছাড়া আর কোনো পথ ছিল না। কাউকে না কাউকে দোকানে বসতেই হতো।’

সঙ্কেতের উঠে আসার সে সময়টা কত কঠিন ছিল, সেটি বোঝা যায় তাঁর স্মৃতিচারণায়, ‘আমরা ধনী ছিলাম না। তবে বাবার কাছে কিছু চাইলে কখনো না করেননি। হ্যাঁ, কিছু জিনিস আনতে সময় লাগত, কিন্তু পেয়েছি। যেমন ধরুন, অনুশীলনের পর প্রোটিন পাউডার পানীয় হিসেবে খেতে হয়েছে। এটার দাম অনেক। সে জন্য প্রায় দুই সপ্তাহ আগেই বাবাকে বলে রাখতাম। বাবা টাকার ব্যবস্থা করে কিনে এনে দিতেন। বাবা আমার জন্য ধার করেছেন। শোধও করেছেন টাকা।’

২০১৯ সালের দিকে জাতীয় পর্যায়ে সাফল্য পেতে শুরু করেন সঙ্কেত। পরের বছর কলকাতায় জিতে নেন ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় জাতীয় পর্যায়ের শিরোপা। সঙ্কেত তখনো পানের দোকানে বসেছেন। ওই দোকান তাঁকে শিখিয়েছে কঠিন পরিস্থিতি কীভাবে সামলাতে হয়। 

কখনো প্রচুর লোকের সমাগম হতো দোকানে। সঙ্কেত জানিয়েছেন, ক্রেতাদের সামলানোর মধ্য দিয়ে নিজের খেলায় চাপ সামলানোর বিষয়েও অনেক কিছু শিখেছেন। সেসব কাজে লাগিয়েই এ বছর সিঙ্গাপুর ওপেনে কমনওয়েলথ রেকর্ড গড়ে জায়গা করে নেন কমনওয়েলথ গেমসে।

বাকিটা ইতিহাস। আর সে ইতিহাসে সঙ্কেতের পদক ও সম্মান ছাড়াও আরও একটি অর্জন আছে, ‘লোকে আগে এটাকে শুধু সঙ্কেতের পানের দোকান হিসেবে চিনেছে। এখন কমনওয়েলথ গেমসে পদকজয়ী সঙ্কেতের পানের দোকান হিসেবে চিনবে।’

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat