লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এবার কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ করতে পারেননি রাজধানীর লালবাগের পোস্তার আড়তদাররা। গত বছর তাঁরা প্রায় দেড় লাখ চামড়া সংগ্রহ করেছিলেন। এবার দুই দিনে সংগ্রহ করা চামড়া এক লাখও ছাড়ায়নি। ফলে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে বাড়তি দামে চামড়া কিনছেন তাঁরা।
গরমের কারণে স্থানীয় পর্যায়ে সংরক্ষণ হওয়ায় এবার চামড়ার সরবরাহ কম বলে মনে করছেন আড়তদাররা। তবে এবার ছাগলের চামড়া কেনায় ব্যবসায়ীদের অনীহা দেখা গেছে। চামড়া সংরক্ষণে লবণের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি ও মৌসুমি ব্যবসায়ীদের পুঁজি সংকটে আশানুরূপ চামড়া সংগ্রহ হয়নি।
রাজধানীতে লবণ দেওয়া গরুর চামড়া ৪৭ থেকে ৫২ টাকা বর্গফুট এবং বাইরে ৪০ থেকে ৪৪ টাকা বেঁধে দিয়েছে সরকার। তবে ঈদের দিন সন্ধ্যায় পোস্তার আড়তদাররা যে চামড়া (পিস) ৫০০ থেকে ৬০০ টাকায় কিনেছেন, রাত ১০টার দিকে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রতি পিস ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। ঈদের পরদিন সোমবার একই চামড়া কিনতে হয়েছে ১২০০ থেকে ১৩০০ টাকায়। গতকাল মঙ্গলবার আরো বেড়ে দাঁড়ায় ১৪০০ টাকা।
ঈদের দিন দুপুরের পর ট্রাক-ভ্যানে রাজধানীর নানা জায়গা থেকে কোরবানির পশুর চামড়া আসতে থাকে পোস্তায়। একটু বেশি লাভের জন্য এক আড়ত থেকে আরেক আড়তে গিয়ে চলতে থাকে মোসুমি ব্যবসায়ীদের দর-কষাকষি।
আড়তদাররা জানান, এবার স্থানীয় পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণ হওয়ায় সরবরাহ কম। পোস্তায় লবণ ছাড়া গরুর চামড়া আকার ও মানভেদে বিক্রি হয়েছে ৩০০ থেকে ১৩০০ টাকা পিস। পাঁচ ফুটের নিচে ছাগলের চামড়া কেনেননি আড়তদাররা। পোস্তায় এবার গরুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক লাখ পিস।
পোস্তা এলাকার আড়তদার আশিকুর রহমান জানান, এবারের ঈদে চামড়ার সরবরাহ কম। তাঁদের সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ছিল চার হাজার পিস। এখন পর্যন্ত কিনেছেন দুই হাজার পিস।
লবণের দাম চড়া : ব্যবসায়ীরা জানান, ছয় মাস আগে ৭৪ কেজির এক বস্তা লবণের দাম ছিল ৬০০ থেকে ৬৫০ টাকা। বর্তমানে একই লবণ বিক্রি হচ্ছে ১০০০ থেকে ১১০০ টাকায়। এতে কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে খরচ অনেক বাড়বে। ১৮-২০ বর্গফুটের একটি কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করতে আট থেকে ১০ কেজি লবণ লাগে। ৭৪ কেজির এক বস্তা লবণে সর্বোচ্চ সাত-আটটি চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা যায়। এ ছাড়া একটি লবণযুক্ত চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে বিক্রি করতে ঢাকায় নেওয়া হলে পরিবহন ব্যয়, শ্রমিক খরচ, আড়ত ভাড়া এবং সব শেষ ট্যানারি মালিকরা চামড়া থেকে ২০ থেকে ২৪ শতাংশ বাদ দেন। সব মিলিয়ে একটি চামড়ার পেছনে আড়তদারদের খরচ হয় প্রায় ৪১০ টাকা।
গত বছরের তুলনায় সাড়ে আট লাখ বেশি পশু কোরবানি : প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলেছে, এবার দেশজুড়ে প্রায় এক কোটি পশু কোরবানি হয়েছে। এটি গত বছরের তুলনায় সাড়ে আট লাখ বেশি। করোনার বিধি-নিষেধ না থাকায় এবার পশু কোরবানি বেড়েছে।
অন্য জেলার তুলনায় এবার ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় পশু কোরবানি বেশি হয়েছে। ঢাকায় এবার কোরবানি হয়েছে ২৪ লাখ ৯১ হাজার ৭৬৮টি পশু। বন্যার কারণে সবচেয়ে কম কোরবানি হয়েছে ময়মনসিংহ ও সিলেটে।
সাভার ট্যানারিপল্লীতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের চাপ নেই : ঈদের তৃতীয় দিন গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সাভারের ট্যানারিপল্লীতে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের চাপ ছিল না। তবে লবণ দেওয়া কিছু চামড়া ঢুকছে সেখানে। চামড়া কম আসায় ব্যস্ততা নেই ট্যানারি শ্রমিকদের। ঈদের সাত দিনের মধ্যে বাইরে থেকে ঢাকায় চামড়া ঢোকায় নিষেধাজ্ঞা থাকায় এবার ট্যানারিপল্লীর শ্রমিকদের ব্যস্ততা কমেছে বলে জানা গেছে।
ব্যবসায়ী নেতারা যা বলছেন : বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াতউল্লাহ বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় চলতি বছর গরুর চামড়ার দাম ভালো। বিক্রেতারা ভালো দাম পাচ্ছেন। চলতি বছর ট্যানারিগুলো এক কোটি ২০ লাখের মতো চামড়া সংগ্রহ করতে পারবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। ’
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশেনের (বিএইচএসএমএ) সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান বলেন, ‘সব কাঁচা চামড়া পোস্তায় না এনে নিজ নিজ এলাকায় লবণ দিতে আমরা সবাইকে অনুরোধ করেছিলাম। এ কারণে পোস্তায় চামড়া কম এসেছে। ’
চট্টগ্রামে লোকসানে আড়তদাররা : সরকার নির্ধারিত দামেই ট্যানারি মালিকরা যাতে কাঁচা চামড়া কেনেন, এই বিষয়টি নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন চট্টগ্রামের আড়তদাররা। তাঁদের মতে, গেল কয়েক বছর করোনার কারণে বিশেষ করে ঢাকার বাইরের কাঁচা চামড়ার আড়তদাররা বিপুল লোকসানের মুখে পড়েন।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকার পর কাঁচা চামড়ার বড় আড়ত চট্টগ্রামে। প্রতিবছর কোরবানি ঈদে এখানে প্রায় চার লাখ চামড়া সংগ্রহ করা হয়। গেল দুই বছর ধরে আমরা করোনার কারণে বেশ লোকসানের শিকার হয়েছি। এবার সরকার কাঁচা চামড়ার দাম কিছুটা হলেও বাড়িয়েছে। তাই আমরা ভালো ব্যবসার আশায় আছি। ’
নাটোরে চাঙ্গাভাব : গতবারের চেয়ে এবার নাটোরের চামড়া বাজারে একটু বেশি দামে চামড়া বেচা-কেনা হয়েছে। তবে সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে নয়, আকারভেদে চামড়া কেনা-বেচা হয়েছে। গরুর কাঁচা চামড়া আকারভেদে ৭০০ টাকা থেকে ১১০০ টাকা এবং ছাগলের চামড়া ২০ থেকে ৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। নাটোর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতি জানায়, বর্তমানে যে চামড়া কেনা-বেচা হয়েছে তা জেলার অভ্যন্তরে বা আশপাশের এলাকার চামড়া। দেশের বৃহত্তম এই চামড়া আড়তে অন্যান্য জেলা থেকে এখনো চামড়া আসতে শুরু করেনি। আগামী শুক্রবার নাগাদ চামড়া আসতে শুরু করবে বলে আশা করছেন নাটোরের আড়ত মালিকরা।
আশানুরূপ চামড়া ওঠেনি রাজারহাটে : দক্ষিণাঞ্চলের সবচেয়ে বড় চামড়ার হাট যশোরের রাজারহাটে গতকাল মঙ্গলবার ছিল প্রথম হাট। এদিন হাটে আশানুরূপ চামড়া ওঠেনি। হাটে আসা বিক্রেতারা বলছেন, সরকার নির্ধারিত দামে তাঁরা চামড়া বিক্রি করতে পারেননি। তবে আড়তদারদের দাবি, ভালো চামড়া সরকার নির্ধারিত দামেই তাঁরা কিনছেন। সাধারণত কোরবানির ঈদের পর এই হাটে ৪০ থেকে ৫০ হাজার চামড়া কেনা-বেচা হয়। তবে গতকাল এই হাটে হাজার পাঁচেক চামড়া ওঠে। হাটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন আগামী শনিবার নাগাদ হাট জমবে।
লোড শেডিং এবং লবণ সংকটে চামড়া ফেলতে হলো মনু নদীতে : মৌলভীবাজারে ২০০ বছরের পুরনো চামড়া ব্যবসাকেন্দ্র বালিকান্দিতে কোরবানির পশুর কয়েক হাজার চামড়া মনু নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, লোড শেডিং আর লবণ সংকটে এমনটা হয়েছে। তাই নষ্ট হয়ে যাওয়া চামড়াগুলো ফেলে দিয়েছেন নদীতে।
গত সোমবার মৌলভীবাজার সদর উপজেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের বালিকান্দি গ্রামের চামড়া ব্যবসায়ীরা ঠেলাগাড়ি বোঝাই করে হাজার হাজার চামড়া মনু নদীতে ফেলে দেন।
মৌসুমি চামড়া ব্যবসায়ী সোহেল বলেন, ‘রাতে বিদ্যুৎ না থাকায় আমরা চামড়ার প্রাথমিক প্রক্রিয়াজাতের কাজ করতে পারিনি। তাই প্রায় এক হাজার চামড়া নদীতে ফেলে দিয়েছি। ’ তিনি আরো বলেন, প্রতিবছর কোরবানির ঈদে লবণের দাম বেড়ে যায়। এবার বড় সমস্যা দেখা দিয়েছে বিদ্যুতের লোড শেডিং।
এ জাতীয় আরো খবর..