×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৬-১৪
  • ২৭২ বার পঠিত
প্রতিবছর বাজেট ঘিরে পত্রিকা-মিডিয়া এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তেজনার পারদ ওঠানামা করে। বিশ্লেষকরা ব্যস্ত হয়ে পড়েন নানামুখী পরিসংখ্যান নিয়ে। কোন জিনিসের দাম কেন বাড়ল, কতটুকু বাড়ল, তা নিয়ে আলোচনার ঝড় ওঠে। সেই রেশ ধরে আমজনতাও কিছুদিন বাজার অর্থনীতি নিয়ে মাথা ঘামায়।

তারপর বাজেটে যে জিনিসের মূল্য বৃদ্ধি হওয়ার কথা ছিল না, তা হতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তারপর মেনে নিতে বাধ্য হয়। বাজেট আলোচনার সাময়িক মুলতবি ঘটে। কারণ প্রবৃদ্ধির হার কতটুকু বৃদ্ধি পেলে সস্তায় মাছ-মাংস-তেল-সবজি ক্রয়ক্ষমতার নাগালে আসবে, তা নিয়ে হিসাব-নিকাশ করার জ্ঞান তাদের নেই। বিশেষ করে বিদেশে পাচার করা কালো টাকা ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে সাদা করা, ব্যাংকের সুদ হ্রাসের সঙ্গে ভ্যাটের আকার বৃদ্ধি ইত্যাদি আলাপ মূলত অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের জন্য নির্ধারিত।

প্রতিবছর বাজেট আলোচনা নিয়ে ব্যস্ত থাকা বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে গত্বাঁধা ‘গরিব মারার বাজেট’ বুলি দেওয়াটাও বিরোধী দলগুলোর অন্যতম কাজ। একই ধারার বিবৃতি শুনতে আমরা অভ্যস্ত প্রতিবছর বাজেট মৌসুম এলে। অবৈধ উপায়ে বিদেশে পাচার করা অর্থ ৭, ১০ অথবা ১৫ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করার প্রস্তাবটি অনৈতিক কিংবা অর্থনীতির সূচকে দরকারি কি না, তা নিয়ে খেটে খাওয়া মানুষের প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে সীমিত।

কাকতালীয় ব্যাপার হলো, আমাদের দেশে এই বাজেট প্রস্তাবের সঙ্গে বিশ্বকাপ ফুটবলে আমাদের অবস্থানের পরোক্ষ শামিল পাওয়া যাবে। যেহেতু এই দুটি ইস্যুতেই গণমানুষের আকাঙ্ক্ষার আপাতত প্রতিফলন দিন শেষে অদৃশ্য।

যেমন—বিশ্বকাপ ফুটবলে আমাদের আগ্রহ প্রতি চার বছর পর উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেলেও জাতীয় দলের অবস্থান ক্রমেই নিম্নমুখী। ফুটবল উন্মাদনার সঙ্গে সমানুপাতিক হারে খেলার মান বাড়েনি। অবকাঠামো-পরিকাঠামো অবয়বে বিশ্ব ফুটবল যতটা এগিয়েছে, পেশাদারিতে আমরা ততটা পিছিয়েছি। শুধু ফুটবলকেন্দ্রিক আমলাতন্ত্রে আমাদের উন্নতি লক্ষণীয়। অতীতে বিশ্বকাপের রেপ্লিকা আসত বাংলাদেশে। ২০১৩ সালে বিশ্বকাপ ট্রফির পাশে দাঁড়িয়ে তখন হাস্যোজ্জ্বল বাফুফের সভাপতি সালাউদ্দিন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশ ২০২২ বিশ্বকাপে খেলবে। এমন নির্লজ্জ প্রতিশ্রুতি বাজেট অধিবেশনে স্বয়ং অর্থমন্ত্রীও দেন না।

কিন্তু এবার বিশ্বকাপ দর্শন ব্যতিক্রম ছিল। এই প্রথম বিশ্বকাপ সফরে ঢাকায় এসেছে ম্যারাডোনা-জিদানরা যে ট্রফিটিতে চুমো খেয়েছিলেন সেটি। কাচের জারের ভেতর সংরক্ষিত থাকায় খুব কাছ থেকে তা ছুঁয়ে দেখতে পারেননি গুরুত্বপূর্ণ ভাগ্যবান ব্যক্তিরা। বিশ্বকাপ ট্রফির সম্মানে বিশিষ্টজনরা নৈশভোজ উপভোগ করেছেন। সেই সঙ্গে ফ্রান্সের ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপজয়ী সদস্য ক্রিস্টিয়ান ক্যারেম্বু ঢাকা সফর করেছেন, উৎসাহ দিয়েছেন আমাদের ফুটবল কর্তাব্যক্তিদের। তাঁর সঙ্গে ছবি তুলে, হাত মিলিয়ে আমরা কৃতার্থ বোধ করেছি।

বরং আমরা কেউ প্রশ্ন তুলিনি এভাবে ফিফার পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা সফরে বিশ্বকাপ ট্রফি চার বছর পর পর সফর করলেও বিশ্ব ফুটবলে আমাদের অবস্থান উন্নীত হওয়ার পূর্বশর্তগুলো বড়দাগে অনুপস্থিত কেন?

তবে আমজনতার উৎসাহ মেটাতে এ উপলক্ষে আরো বরাদ্দ ছিল গানের কনসার্ট। ফুটবলকেন্দ্রিক এই অনুষ্ঠানে ছিল না কোনো প্রীতি ফুটবল ম্যাচের আয়োজন কিংবা মাঠ পর্যায়ে ফুটবলের উন্নয়নে গৃহীত কোনো কর্মযজ্ঞ। শুধু ফুটবলকে উপজীব্য করে বিনোদনের পসার। সেটিও ফুটবলপ্রেমী দর্শকদের ওপর ভর করে। এর পরও আমাদের বাফুফে বিশ্বকাপ উপলক্ষে বিশেষ প্রস্তুতি নেবে। স্পন্সরে সওয়ার হয়ে সারা দেশের প্রধান শহর ও ঢাকা শহরের নানা স্পটে জায়ান্ট স্ক্রিনে খেলা দেখাবে। ফুটবলকে ডোবানোর জন্য দায়ী এই সংগঠনের এজাতীয় তৎপরতায় প্রতিবাদ করা দূরের কথা, খুশিতে আহ্লাদিত হই। ফুটপাত, শপিং মলে যেসব দেশ বিশ্বকাপ খেলছে, সেসব দেশের মধ্যে যারা আমাদের আমজনতার মধ্যে প্রিয়, তাদের জার্সি দেদার বিক্রি হতে দেখি। যে গরিব ছেলেটির ঈদের কাপড় কেনার সামর্থ্য নেই, সেও পয়সা খরচ করে সেসব নীল, সাদা, হলুদ, কমলা জার্সি জোগাড় করার চেষ্টা করে।

বিশ্বকাপ ফুটবলের বিষয়গুলো খতিয়ে দেখলে বাজেটের আয়োজনের সঙ্গে মিল পাওয়া যায়।

প্রতিবছর সাধারণ জনগণের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের কথা মাথায় রেখে নীতিনির্ধারকরা বাজেটের কলেবর সাজান। প্রতিবছর বাজেটের আকার বৃদ্ধি পেলেও জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলনে বিশাল ঘাটতি যেন সাধারণ ব্যাপার। এর পরও প্রস্তাবিত বাজেটে যদি মূল্যস্ফীতি রোধ করার কার্যকর পথ আবিষ্কার করা যায়, তাহলে জনগণের দুর্ভোগ কিছুটা কমবে—এমন আশাবাদও লক্ষ করা যায়। এর পরও এমন আশার বিপরীতে হতাশাগ্রস্ত হওয়ার মতো কারণগুলো খোলাবাজারে স্পষ্ট হয়ে পড়ে।

যখন বলা হয়, প্রস্তাবিত বাজেট প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, ব্যবসায়ী ও স্বল্প আয়ের জনগণসহ সব শ্রেণির মানুষের জন্য সহায়ক হবে, তখন মনে হতে পারে ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা কিংবা জার্মানি-ফ্রান্সের ফুটবল কোচরা বিশ্বকাপ ম্যাচের শুরুতে তাঁদের দল নিয়ে আশার বাণী শোনাচ্ছেন। যেভাবে তাঁরা বলেন, এবারের দলটি সবচেয়ে গোছানো এবং ভাগ্য সহায় থাকলে যেকোনো দলের বিপক্ষে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারে, তবে প্রতিপক্ষের ব্যাপারে আমরা সজাগ থাকব।

বিশ্বকাপ ফুটবলে পরদেশি দলকে সমর্থন দিয়ে অভ্যস্ত হয়ে পড়া জাতির জীবনে বার্ষিক বাজেট যেন রুটিনমাফিক এক অর্থনৈতিক বিনোদন। খেলা বনাম অর্থনীতি দুই পর্যায়েই জয়-পরাজয় অথবা লাভ-ক্ষতির হিসাবটা রীতিমতো আপেক্ষিক ও দ্বিধাবিভক্ত। কেউ কেউ সন্তুষ্ট হবে কিংবা হবে না। বিশ্বকাপ ফুটবল এবং বাজেট অধিবেশন নিয়ে আমাদের বিশ্লেষণ-বিতর্ক অব্যাহত থাকবে, এর কোনো ব্যত্যয় হবে না।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat