মাঠের বিরোধী দল বিএনপি-শিবিরে হঠাৎ করেই জাতীয় নির্বাচনের জোর প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। শুধু তাই নয়, নির্বাচনি ইশতাহার কী হবে, তা নিয়েও কাজ এগিয়েছে অনেকদূর। দলটির নীতিনির্ধারকরা আগামী জাতীয় নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ব্যাপারেও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। কিন্তু ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অধীনেও নির্বাচন না করার ব্যাপারে তারা অনড়। যুগান্তরকে এমনটি নিশ্চিত করেছে দায়িত্বশীল সূত্র। কিন্তু এমন সাংঘর্ষিক অবস্থান নিয়ে বিএনপি কীভাবে তাদের প্রত্যাশিত নির্বাচনি মাঠের দেখা পাবে-এমন প্রশ্নের জবাবে অনেক কৌশলী উত্তর দিয়েছেন কয়েকজন সিনিয়র নেতা। তারা যুগান্তরকে বলেন, ‘পরীক্ষার আগে যদি সব প্রশ্নের উত্তর আগাম দিয়ে দিই তাহলে তো পরীক্ষা থাকে না। অপেক্ষা করেন। সময় হলেই সব জানতে পারবেন। জনগণ তার ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে এই সরকারকে সময়মতো বাধ্য করবেই। এবার আর আগের মতো জোর করে ক্ষমতায় থাকা যাবে না।’
বিএনপির দুজন নীতিনির্ধারক নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ‘নির্বাচনে ভোটারদের কাছে টানার প্রস্তুতি অনেকটা ফাইনাল পরীক্ষার আগে প্রি-টেস্টের মতো। জনগণের সামনে আমরা সরকারের নানা অনিময় তুলে ধরব। তারা কোন বিষয়গুলো গ্রহণ করল বা কোনটা রিজেক্ট করল, তা পর্যালোচনা করা হবে। এরপর সংশোধন করা হবে প্রাথমিক পরিকল্পনা। এভাবে ফাইনালের আগে আমরা প্রি-টেস্ট ও টেস্ট পরীক্ষা দিতে চাই। জনগণ যেসব প্রতিশ্রুতিগুলো গ্রহণ করবে, সেগুলো স্থান পাবে আমাদের নির্বাচনি ইশতাহারে।’ তারা জানান, বিএনপি জনগণের সামনে সরকারের এমন কিছু প্রমাণিত ব্যর্থতা এবং অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য সামনে আনবে, যা জানার পর যে কোনো নাগরিক বিএনপিকে সাহসের সঙ্গে স্যালুট জানাবে। আমরা শুধু রাজনৈতিক কারণে সরকারের বিরোধিতা করছি না, করবও না। আমরা এই সরকারের অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্যগুলো জনগণের সামনে আনার ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। কীভাবে তারা উন্নয়ন করার নামে ভয়াবহ দুর্নীতি করেছে, সেটি তুলে ধরা হবে। এছাড়া যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো একেবারে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে এসেছে, সেগুলোর বেহাল অবস্থা জাতিকে জানানো হবে।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রথমত আমরা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে যাচ্ছি না। নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি প্রতিষ্ঠা করেই বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে। সেই নির্বাচনে যাওয়ার প্রস্তুতি আমাদের রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘ধানের শীষের প্রতি এমনিতেই মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস রয়েছে। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হলে ভোটাররা ধানের শীষকেই বেছে নেবে। তারপরও ভোটারদের কাছে টানতে আমাদের নানা পরিকল্পনা রয়েছে। সেগুলো আমরা তৈরি করছি। এই মুহূর্তে তা জানাতে চাই না। সময় হলে আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির সামনে সেগুলো তুলে ধরব।’
খসরু বলেন, ‘মূলত সরকারের নানা দুর্নীতি, লুটপাট ও গুরুতর অনিয়মের বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে। তবে এ থেকে কীভাবে উত্তরণ সম্ভব, সেদিকেই আমরা বেশি গুরুত্ব দেব। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে এমন একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাই, যেখানে কোনো বৈষম্য থাকবে না। সব সেক্টরে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হবে।’ তিনি মনে করেন, জবাবদিহি নিশ্চিত করা সম্ভব হলে অনিয়ম, লুটপাট এমনিতেই কমে যাবে।
দলটির নীতিনির্ধারকরা জানান, আগামী নির্বাচন বিএনপির জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ। শুধু বিএনপি নয়, দেশের মানুষও ওই নির্বাচনকে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করছে। দীর্ঘদিন ধরে তারা ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। উৎসবমুখর পরিবেশে তারা ভোট দিতে চায়। বিএনপির এই মুহূর্তে মূল দায়িত্ব হচ্ছে মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়া। নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। গুরুত্বপূর্ণ এ কাজটি করতে পারলে বিএনপির প্রতি সাধারণ ভোটারদের একটা আস্থা তৈরি হবে। সুষ্ঠু ভোট আয়োজনের পাশাপাশি ক্ষমতায় গেলে বিএনপি কী করতে চায়, এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট একটি পরিকল্পনা জাতির সামনে তুলে ধরা হবে। এ লক্ষ্যে দলের নীতিনির্ধারকরা কাজ করছেন। প্রতিটি সেক্টরভিত্তিক সরকারের নানা ব্যর্থতা তুলে ধরার পাশাপাশি এর সমাধানে বিএনপি কী করতে চায়, এ বিষয়ে রোডম্যাপও থাকবে ওই পরিকল্পনায়। তারা আরও জানান, বিএনপির প্রতি সাধারণ মানুষ যাতে আস্থা আনতে পারে, সেজন্য দেশের বিভিন্ন পেশার গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের কাজে লাগানোর চিন্তাও করা হচ্ছে। ক্ষমতায় গেলে প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না। এছাড়া সবার মতামতের ভিত্তিতে রাষ্ট্র পরিচালনা করাসহ সব জায়গায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্থায়ীভাবে দলীয়করণের হাত থেকে রক্ষাসহ জাতীয় কয়েকটি জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয় থাকবে ওই রোডম্যাপে।
দলটির নেতারা মনে করেন, সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি, অনিয়ম, নির্যাতন, রাষ্ট্র পরিচালনায় নানা ব্যর্থতায় মানুষ বিএনপিকে ঘিরে স্বপ্ন দেখছে। ভোটাররা মনে করছে, বিএনপিই একমাত্র বিকল্প। তাই সারা দেশের মানুষ তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। এখন প্রয়োজন ভোটারদের আস্থায় আনা। বিএনপি ভবিষ্যতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে কী করতে চায়, সে বিষয়ে একটি ইতিবাচক বার্তাও জনগণের মধ্যে পৌঁছে দিতে হবে। ভোটারদের আকৃষ্ট করতে শুধু সরকারের নয়, দলটি আত্মসমালোচনা করতেও দ্বিধা করবে না। অতীতে রাষ্ট্র পরিচালনায় বড় দাগে তারা কী কী ভুল করেছিল, তা তুলে ধরার পাশাপাশি ভবিষ্যতে এ থেকে শিক্ষা নিয়ে কাজ করার প্রতিশ্রুতি থাকবে। জানতে চাইলে গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপির অবস্থান নিয়ে সাধারণ মানুষ এখনো দ্বিধায় রয়েছে। আগামী দিনে বিএনপি কী করতে চায়, তা এখনই স্পষ্ট করতে হবে। ভোটাররা কেন তাদের প্রতি আস্থা রাখবে, তা পরিষ্কার করতে হবে। তিনি মনে করেন, ভোটারদের কাছে টানতে জাতির সামনে কিছু প্রতিশ্রুতি দিতে হবে বিএনপিকে। ক্ষমতায় গেলে তারা প্রতিহিংসার রাজনীতি করবে না-সবার আগে দিতে হবে এ প্রতিশ্রুতি।
মানুষ যাতে সেটা বিশ্বাস করে, সেই আস্থার জায়গা তৈরি করতে হবে।’
বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলু যুগান্তরকে বলেন, ‘এ সরকারের অধীনে আমরা আগামী নির্বাচনে যাব না। নির্বাচনকালীন সরকার প্রতিষ্ঠা করেই তাদের অধীনে নির্বাচনে যাবে বিএনপি। ওই নির্বাচনে সাধারণ ভোটাররা নানা কারণেই বিএনপিকে সমর্থন জানাবে। শুধু দুর্নীতি আর লুটপাট নয়, জনগণ দেখতে পাচ্ছে তাদের ভোটাধিকার নেই। স্বাধীনতা নেই বিচার বিভাগ, গণমাধ্যমসহ সাধারণ মানুষের কথা বলার। এমনকি সাধারণ মৃত্যুর গ্যারান্টিও নেই। যোগ্যতা থাকার পরও অনেকে চাকরি পাচ্ছে না। কারণ সব জায়গায় চলছে দলীয়করণ।’
তিনি বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গিয়ে এসব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনা থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে চায়। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের জন্য এমন কিছু দিতে চাই যাতে তারা বিএনপির প্রতি আস্থা রাখতে পারে। সবমিলে আগামী দিনে ক্ষমতায় গেলে দেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনাই হবে বিএনপির অন্যতম কাজ।’
এ জাতীয় আরো খবর..