ঢাকার মিরপুরের জাতীয় চিড়িয়াখানায় প্রবেশের টিকিট ইজারা, প্রাণীদের জন্য প্রায় ৯ রকমের খাবার সরবরাহের জন্য প্রতিষ্ঠান নির্বাচন, পাঁচ প্রজাতির প্রাণী সরবরাহ এবং ৩৪ কোটি টাকার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়ম হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আর এর ফল ভোগ করছে চিড়িয়াখানার প্রাণীরা।
চিড়িয়াখানা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়। এই মন্ত্রণালয়ের ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বিশেষ এক নিরীক্ষা প্রতিবেদনেও বলা হয়, জাতীয় চিড়িয়াখানায় নিয়ম-নীতি না মানায় বছরটিতে ৩২ লাখ ৬৮ হাজার ৫১৯ টাকা ক্ষতি হয়েছে।
টিকিট ইজারা
চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) জন্য চিড়িয়াখানায় প্রবেশের টিকিট বিক্রির ইজারা দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি ৯৬ লাখ টাকায়। মেসার্স শিখা ট্রেডার্স নামের প্রতিষ্ঠানটি ছিল দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সর্বোচ্চ ১১ কোটি ১০ লাখ টাকা প্রস্তাবকারী মেসার্স ইউপি ট্রেডিংকে কাজটি দেয়নি। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ জানায়, সর্বোচ্চ দরদাতার আয়করসংক্রান্ত একটি কাগজ ছিল না বলে কমিটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়নি।
প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, ২০২১-২২ অর্থবছরেও টিকিট বিক্রির ইজারার ক্ষেত্রে অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল। সেবার সর্বোচ্চ দরদাতা ছিল মেসার্স এইচ এন ব্রিকস, দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মেসার্স ইউপি ট্রেডিং ও তৃতীয় ছিল মেসার্স রাইদ ট্রেডিং। মেসার্স এইচ এন ব্রিকস ১১ কোটি পাঁচ লাখ টাকা দর দেয়। কমিটি তাকে নির্বাচনও করে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে প্রতিষ্ঠানটি ইজারা নিতে রাজি হয়নি। নিয়মানুযায়ী কার্যাদেশ দেওয়া হয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ইজারাদার মেসার্স ইউপি ট্রেডিংকে ১০ কোটি ৩০ লাখ টাকায়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই ইজারায় অংশ নেওয়া প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা প্রতিষ্ঠান তিনটি একই পরিবারের। মেসার্স এইচ এন ব্রিকসের মালিক লুতফর রহমান। বাকি দুটি প্রতিষ্ঠানের মালিক তাঁর দুই ছেলে আশিক ইমরান ও রাকিব ইমরান। ফলে মেসার্স ইউপি ট্রেডিং দ্বিতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হয়ে কাজ পেলেও তা মূলত প্রথম সর্বোচ্চ দরদাতাই পেয়েছে। এই কারসাজির কারণে চিড়িখানা প্রায় সাড়ে ৯৭ লাখ টাকা কম রাজস্ব পায়।
অভিযোগ ওঠার পর চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ মেসার্স এইচ এন ব্রিকসের লুতফর রহমানকে কারণ দর্শানোর চিঠি দেয়। তাতেই এই তিন প্রতিষ্ঠানের মালিক যে লুতফর রহমান তা উল্লেখ করা হয়। এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট জবাব দিতে চায়নি চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ।
খাবার সরবরাহের প্রতিষ্ঠান নিয়োগে অনিয়ম
চিড়িয়াখানার প্রাণীদের জন্য বছরে ন্যূনতম ১০ কোটি টাকার খাবার কিনতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে মাংস, ফলমূল, সবজি, ঘাস, দানাদার খাবার, শাক, খরখোশ ও মুরগি, মাছ, ভুসি প্রভৃতি। চলতি অর্থবছরে মাংসাশী প্রাণীদের জন্য মাংস সরবরাহ করছে মেসার্স সামির ইন্টারন্যাশনাল। মাসে ২২ দিন মাংসাশী প্রাণীদের ষাঁড়ের মাংস দেওয়ার কথা। দিনে ১৩৮ কেজি মাংস ৭৪৫ টাকা কেজি দামে সরবরাহ করে এ প্রতিষ্ঠান।
চুক্তিপত্রে শুধু মাংস সরবরাহ করার কথা থাকলেও মাংসের সঙ্গে দেওয়া হয় চর্বি ও হাড়। সরেজমিনে গিয়ে সিংহসহ বিভিন্ন মাংসাশী প্রাণীর খাঁচার ভেতর হাড় ও চর্বি পড়ে থাকতে দেখা গেছে। বলা হয়ে থাকে, এই চর্বি প্রাণীদের রুগ্ণ করে।
বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব জু অফিসার (মাংস শাখা) গোলাম আজমের। তিনি প্রায় ১৪ বছর ধরে এই দায়িত্ব পালন করছেন। এ বিষয়ে জানতে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়; কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
প্রাণীদের জন্য ফলমূল সরবরাহ করছে শিখা ট্রেডার্স। ভুসিও সরবরাহ করছে তারাই। টিকিটের ইজারাও পেয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।
সবজি সরবরাহ করছে সুমন ট্রেডার্স। ঘাস সরবরাহ করছে মাহাবুব ইন্টারপ্রাইজ। দানাদার খাবার সরবরাহ করছে সাগর এন্টারপ্রাইজ। শাক সরবরাহ করছে নাহার ট্রেডার্স। খরগোশ ও মুরগি সরবরাহ করছে সুমন ট্রেডার্স (২)। মাছ সরবরাহ করছে নবাব ইন্টারন্যাশনাল।
প্রাণী পুষ্টি ও নিরাপত্তা শাখার ইনচার্জ এস এম জলিল এসব প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা খাবারের পরিমাণ ও মান যাচাই করার দায়িত্বে আছেন। গতকাল ফোন করা হলে তিনিও এ বিষয়ে কথা বলতে রাজি হননি। জলিল ১১ বছর ধরে এই চিড়িয়াখানায় আছেন।
প্রাণী কেনায় অনিয়ম
করোনা মহামারির মধ্যে গত বছর চিড়িয়াখানার জন্য বিদেশি পাঁচ প্রজাতির ২০টি পশু কেনা হয়। এর মধ্যে আফ্রিকা থেকে আনা সিংহ ও ব্লু ওয়াইল্ড বিস্ট এবং ইউরোপ থেকে আনা রেড ক্যাঙ্গারু, লামা, প্যালিক্যান কেনার ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত মানা হয়নি বলে অভিযোগ আছে। পাঁচ কার্যাদেশে এই প্রাণী কেনা হয়। চিড়িয়াখানার তৎকালীন কিউরেটর ডা. মো. আবদুল লতিফ অবসরে যাওয়ার দিন ২০২১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি কার্যাদেশে স্বাক্ষর করেন। পাঁচটি কাজই পায় সিনান বার্ডস ব্রিডিং ফার্ম। তারা মূলত পাখি নিয়ে কাজ করে।
নথিপত্রে দেখা যায়, এর আগে ২০২০ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এই পাঁচ প্রজাতির প্রাণী ক্রয়ের জন্য লুফটেক্স লিমিটেডকে কার্যাদেশ দিয়েছিল চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ। কিন্তু করোনার কারণে প্রতিষ্ঠানটি প্রাণী সরবরাহ করতে পারেনি। ২০২১ সালের ২৯ নভেম্বর আফ্রিকান সিংহসহ এই প্রাণীগুলো কেনার জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু এই দরপত্রে কারিগরি ত্রুটি আছে জানিয়ে আবার দরপত্র আহ্বান করা হয়। কিন্তু এবার কিছু শর্ত শিথিল করা হয়।
প্রথম দরপত্রে আফ্রিকান সিংহ সরবরাহের ক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ৪৮ লাখ টাকার বন্য প্রাণী ও পাখি বিক্রির অভিজ্ঞতা থাকার শর্ত ছিল। পরে দরপত্রে এই শর্তটি শিথিল করে ৪৫ লাখ টাকায় নামিয়ে আনা হয়। এই দরপত্রের আওতায় চারটি আফ্রিকান সিংহ কেনা হয়। মোট খরচ হয় ৩৫ লাখ ১২ হাজার টাকা। সিনান বার্ডস ব্রিডিং ফার্ম এই সিংহ সরবরাহ করে।
একইভাবে রেড ক্যাঙ্গারু কেনার দরপত্রের শর্তও শিথিল করা হয়। প্রথম দরপত্রে ৪৫ লাখ টাকার বন্য প্রাণী ও পাখি বিক্রির অভিজ্ঞতা চাওয়া হলেও দ্বিতীয় দরপত্রে তা ৪০ লাখ টাকায় নামিয়ে আনা হয়। এই দরপত্রের আওতায় চারটি রেড ক্যাঙ্গারু কেনা হয়। যার জন্য ৩৫ লাখ ১৬ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এগুলোও সরবরাহ করে সিনান বার্ডস ব্রিডিং ফার্ম।
একই প্রতিষ্ঠান ২৭ লাখ ৩৬ হাজার টাকায় চারটি ব্লু ওয়াইল্ড বিস্ট সরবরাহ করে। চারটি লামাও তারা সরবরাহ করেছে। তবে তার দাম জানা সম্ভব হয়নি।
এসব বিষয়ে জানতে চাইলে চিড়িয়াখানার সাবেক কিউরেটর ডা. মো. আবদুল লতিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি যা করেছি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ মেনেই করেছি। কোনো দুর্নীতি করিনি। দরপত্র মূল্যায়ন কমিটিই কাগজপত্র দেখে ঠিক করে দেয় কে প্রাণী সরবরাহের কাজ পাবে। ’
৩৪ কোটি টাকার প্রকল্পে অনিয়ম
ঢাকার জাতীয় চিড়িয়াখানা ও রংপুর চিড়িয়াখানার মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন এবং অপরিহার্য অবকাঠামো সংস্কার ও উন্নয়নে প্রায় ৩৪ কোটি টাকার প্রকল্প নেয় প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা চিড়িয়াখানার অবকাঠামো সংস্কার ও মেরামত, পার্কিং এরিয়া মেরামত, সার্কুলার রোড মেরামত, প্রক্ষালন কক্ষ সংস্কার, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, শিশু পার্কের যন্ত্রপাতি রিমডেলিং, লেকের সৌন্দর্যবর্ধন ও ঢাকা চিড়িয়াখানার গেটের সামনে প্ল্যাটফরম নির্মাণ করার কথা ছিল। এই সঙ্গে প্রকল্পটিতে রংপুর চিড়িয়াখানার আধুনিক নকশা ও সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ করার কথা বলা হয়।
প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০১৮ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত। কিন্তু চলতি বছরের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়।
সরেজমিনে জাতীয় চিড়িয়াখানায় গিয়ে দেখা গেছে, সীমানাপ্রাচীর নির্মাণ, শিশু পার্কের যন্ত্রপাতি রিমডেলিং, লেকের সৌন্দর্যবর্ধন ও প্রধান ফটকের সামনে প্ল্যাটফরম নির্মাণ, গাড়ি পার্কিং এলাকা বাড়ানোর কাজ প্রকল্প অনুযায়ী হয়নি। শিশু পার্কে চার-পাঁচটি উপকরণ আছে। এর মধ্যে ট্রেনটি ঠিকঠাক চলছে। বাকি উপকরণগুলোর অবস্থা ভালো নয়। পার্কিংয়ের জায়গা বাড়েনি বলে দাবি সেখানকার কর্মীদের।
৩৪ কোটি টাকার এই প্রকল্পের শুরুতেই বিতর্ক সৃষ্টি করেন সাবেক কিউরেটর নজরুল ইসলাম। প্রকল্পটি পাস করিয়ে পদাধিকারবলে তিনি প্রকল্প পরিচালক হন। আর প্রকল্প পরিচালক হয়েই দুর্নীতির অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সহকারী প্রকৌশলী মো. আলী আকবরকে পরামর্শক নিয়োগ করেন তিনি। এর আগেই আলী আকবরের বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগে আটটি মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। পরে অবশ্য পরামর্শক পাল্টাতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ।
জানতে চাইলে সাবেক কিউরেটর নজরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রকল্পটি আমি পাস করিয়েছি। এরপর কয়েকটা কাজের অর্ডার দিয়েছি। আমি কোনো দুর্নীতি করিনি। আমি অবসরে গেলে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পান ডা. মো. নুরুল ইসলাম ও ডা. মো. আবদুল লতিফ। এখন এ বিষয়ে উনারা বলতে পারবেন। ’
সাবেক কিউরেটর ডা. মো. আবদুল লতিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি এ প্রকল্পের যে কাজগুলো করেছি সেগুলোতে কোনো দুর্নীতি হয়নি। টাকার পরিমাণ কম থাকায় প্রকল্পে উল্লেখ করা সব কাজ সঠিকভাবে করা সম্ভব হয়নি। ’
চিড়িয়াখানার বর্তমান পরিচালক ডা. মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম তালুকদার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি নতুন এসেছি। এসব বিষয়ে এখনো জানি না। তবে নির্দিষ্ট কোনো অভিযোগ পাওয়া গেলে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ’
এ জাতীয় আরো খবর..