×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৭-৩০
  • ৭৫ বার পঠিত
বড় স্বপ্ন নিয়ে ইউরোপে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন তাঁরা। তবে সেই স্বপ্নের যাত্রা একসময় মৃত্যুর শোকে মলিন হয় প্রিয়জনদের কাছে। অবৈধ পথে ইউরোপে যাত্রা করে লাশ হন তরুণরা। আর দেশে স্বজনরা কাটান দুঃসহ জীবন।

অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার সময় মুক্তিপণের জন্য লিবিয়ায় বন্দি হয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার তরুণদের পরিবারগুলোর কেউ হারিয়েছে সন্তান, কেউ হারিয়েছে ভাই, কেউ হারিয়েছ স্বামী। মুক্তিপণ দিয়ে স্বজনকে দেশে ফেরানোর আশায় হারিয়েছেন নিজের শেষ সম্বলটুকুও। শরীয়তপুর-মাদারীপুরে শতাধিক পরিবার এমন পরিস্থিতির শিকার।

এমন প্রেক্ষাপটে আজ শনিবার (৩০ জুলাই) বিশ্ব মানবপাচার বিরোধী দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটি সামনে রেখে এই প্রতিবেদক কথা বলেছেন অবৈধ পথে লিবিয়ায় গিয়ে পাচারকারীদের বন্দিশালায় মুক্তিপণের জন্য স্বজনকে মেরে ফেলা হয়েছে, এমন অন্তত ১৫টি পরিবারের সঙ্গে। তাঁদের একজন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার মোল্লাদি গ্রামের মুকুল শেখ।

মুকুল কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁর চাচাতো ভাই রুবেল সরদার দালালদের ধরে লিবিয়া যান। সেখানে দালালরা মুক্তিপণের জন্য বন্দি করে রুবেলকে। প্রায় ৯ মাস অনাহার-অর্ধাহারে ও নির্যাতনের শিকার হয়ে একপর্যায়ে আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইএমও) সহযোগিতায় গত ৩ মার্চ দেশে ফেরার কথা ছিল। রুবেলকে নিতে সকাল সকাল ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন তিনি। কারণ রুবেলের বাবা বেঁচে নেই। আর বড় কোনো ভাইও নেই। সকাল ৭টা থেকে রুবেলের ছবি হাতে নিয়ে হাঁটছিলেন বিমানবন্দরের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত।

ওই দিন সকাল সোয়া ৮টায় আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার উদ্যোগে লিবিয়া থেকে আসা বিআরকিউ-২২০ চার্টার্ড ফ্লাইটে লিবিয়ার বন্দিদশা থেকে ১১৪ বাংলাদেশি ঢাকায় ফেরেন; কিন্তু ফেরেননি রুবেল। লিবিয়া থেকে ফেরা কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে মুকুল জানতে পারেন রুবেল বেঁচে নেই।

ওই সময় লিবিয়াফেরত কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁরা জানিয়েছিলেন, রুবেল ১৫ ফেব্রুয়ারি মারা গেছেন।  সেদিন বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও আইওএমের উদ্যোগে বন্দিশিবিরে ভালো খাবার দেওয়া হয়। দীর্ঘদিন ধরে না খেয়ে থাকা রুবেল খাবার পেয়ে পেট ভরে খানও। সেদিনই রুবেল মারা যান। এরপর লাশ কোথায় নেওয়া হয়েছে, তাঁরা তা জানেন না।

এদিকে মুকুল শেখ কালের কণ্ঠকে জানান, রুবেলের বাবা নেই। বৃদ্ধ মা আর বোন। ছোট একটি ভাইও আছে। একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলেকে হারিয়ে তার মা এখন পাগলপ্রায়। দালালকে টাকা দিতে গিয়ে শেষ সম্বলটুকুও হারিয়েছেন। পরিবারটি এখন মানবেতর জীবন যাপন করছে।

রুবেলের স্বজনদের মতোই পরিস্থিতি আরো অনেকের। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাগরে ডুবে মরলে খবর হয়। সবাই জানে। লাশের ছবি হলেও দেশের স্বজনরা দেখতে পায়; কিন্তু বন্দিশিবিরে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা যাওয়াদের খবর কেউ জানে না। লিবিয়ায় দালালরা নির্যাতন করে বন্দিশিবিরেই মেরে ফেলছে, সেটা স্বজনরা জানছে অনেক দিন পর। এর মধ্যে স্বজন জীবিত আছে মনে করে দালালকে টাকা দিতে দিতে নিঃস্ব হয়ে যায় কোনো কোনো পরিবার।

এমন এক পরিবারের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। ভেদরগঞ্জ উপজেলার নারায়ণপুর ইউনিয়নের দুলাল দেওয়ান। তিনি কালের কণ্ঠকে জানান, অবৈধ পথে ইতালি যাওয়ার সময় লিবিয়ায় তাঁর ছেলে শাকিল দেওয়ান বন্দি হন দালালদের হাতে।   নির্যাতন থেকে বাঁচাতে দেন কয়েক দফা মুক্তিপণ। ক্রমাগত নির্যাতনের একপর্যায়ে শাকিল অসুস্থ হয়ে পড়লে দালালরা তাঁকে জনমানবহীন রাস্তায় গাড়ি থেকে ছুড়ে ফেলে চলে যায়। সেখানেই তাঁর নির্মম মৃত্যু হয়। অথচ মৃত্যুর পরও শাকিলের পরিবারের সঙ্গে কথা চালিয়ে যায় দালালরা।

দালালরা জানায়, শাকিল হাসপাতালে। এই বলে চিকিৎসার ও খাবারের কথা বলে প্রায় ১২ লাখ টাকা নেয়। পরে আইসিইউর কথা বলে আরো ৯ লাখ টাকা চায়। সেদিনই অন্য এক দালালের মাধ্যমে শাকিলের বাবা জানতে পারেন ২০ দিন আগেই শাকিল মারা গেছেন।

বাংলাদেশ থেকে সাধারণত ইউরোপের ইতালি ও গ্রিস, মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই, সৌদি আরব, বাহরাইন, ভারত, সিরিয়াসহ মালয়েশিয়াতে মানবপাচারের ঘটনা বেশি ঘটে।

ব্র্যাক ইমিগ্রেশনের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে মধ্যপ্রাচ্যে কাজের কথা বলে অনেককেই বিক্রি করে দেওয়ার অভিযোগ আছে। দুবাইয়ে বিভিন্ন ডান্স ক্লাবে কাজের কথা বলে নারী পাচার করা হচ্ছে। এমনকি সিরিয়ায়ও অনেককে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে বিদেশে কাজের কথা বলে নেওয়া নারীদের ওপর নানা ধরনের নিপীড়ন বাড়ছে। গত ছয় বছরে অন্তত ১০ থেকে ১২ হাজার নারী নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে দেশে ফিরেছেন। এর মধ্যে ২০২১ সালে ছয় হাজার ৬৩৮ জন এবং এই বছরের প্রথম ছয় মাসে আড়াই হাজার নারী ফেরত এসেছেন।

২০১৯ সালের ২৬ আগস্ট সৌদি আরবফেরত ১১০ নারী গৃহকর্মীর সঙ্গে কথা বলে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, ৩৫ শতাংশ নারী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেনে। ৪৪ শতাংশ নারীকে নিয়মিত বেতন দেওয়া হতো না।

দেশে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে মন্ত্রণালয় তাঁদের ফিরে আসার ১১টি কারণ চিহ্নিত করেছে। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেরত আসা নারী কর্মীদের মধ্যে ৩৮ জন শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান শরিফুল হাসান কালের কণ্ঠকে বলেন, ২০১৫ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ লাখ লোক ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। এর মধ্যে সাগরে ডুবেই অন্তত ২১ হাজার মানুষ মারা গেছে। যাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য একটি অংশ বাংলাদেশি।

ব্র্যাক অভিবাসন কর্মসূচি জানায়, তাদের কাছে বন্দিশিবিরে নির্যাতনের কারণে মৃত্যু ও মুক্তিপণের জন্য হত্যার শিকার ব্যক্তিদের কোনো পরিসংখ্যান নেই।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat