প্রতিবছর ঈদের ছুটিতে পর্যটকদের পদচারণে মুখর থাকে দেশের সব পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু এবার তা হয়নি। বন্যায় এখনো ডুবে আছে সিলেট—এমন ভুল বার্তায় সেখানকার পর্যটনে ধস নেমেছে। একই কারণে তেমন পর্যটক পায়নি সুনামগঞ্জ ও মৌলভীবাজার।
এ ছাড়া তীব্র গরমের কারণে পর্যটক খুবই কম ছিল কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক ও নওগাঁর বদলগাছী উপজেলার পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহারে।
তবে এবার মুন্সীগঞ্জের পদ্মা সেতু, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, ভোলা, বাগেরহাটসহ দক্ষিণাঞ্চলের পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে ছিল পর্যটকের ঢল।
সিলেটে সৌন্দর্য বাড়লেও পর্যটনে হোঁচট
বন্যা বিদায় নিয়েছে সিলেট থেকে। বন্যাকবলিত উপজেলাগুলোর যেসব নিম্নাঞ্চলে এখনো পানি আটকে আছে, সেগুলোও প্রতিদিন কমছে। বন্যার তাণ্ডব শেষে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সৌন্দর্য আরো বেড়েছে। কিন্তু ভরা মৌসুমেও খাঁ খাঁ করছে হোটেল-মোটেলগুলো। তাদের বুকিং খাতার হিসাবে এবার ৫ শতাংশ পর্যটকও সিলেটে আসেনি।
গতকাল মঙ্গলবার কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ভোলাগঞ্জের সাদা পাথরে গিয়ে দেখা যায়, অল্পসংখ্যক দর্শনার্থী ঘুরাফেরা করছে। চরম হতাশা ভর করেছে নৌকার মাঝি, আলোকচিত্রী থেকে শুরু করে পর্যটন ব্যবসায়ীদের মধ্যে।
নৌকার মাঝি মনির হোসেন বলেন, ‘গত ঈদের ছুটির দিন প্রতিদিন ১০ থেকে ১৫টি ট্রিপ দিয়েছি। এ বছর তিনটি ট্রিপও পাওয়া যাচ্ছে না। বন্যায় বাড়িঘরের অনেক ক্ষতি হয়েছে। ভেবেছিলাম ঈদের সময় আয় করে বাড়িঘর মেরামত করব। পর্যটক কম আসায় তা-ও হচ্ছে না। ’
শুধু সাদা পাথর নয়, দেশের একমাত্র জলাবন রাতারগুল, বিছানাকান্দি, প্রকৃতিকন্যা জাফলং, পাংতুমাই, মায়াবী ঝর্ণা থেকে শুরু করে সিলেটের চা বাগানগুলোতেও নেই পর্যটকদের আনাগোনা। এসব স্থানে অল্পসংখ্যক যেসব দর্শনার্থী ঘুরতে এসেছে তাদের ৮০ শতাংশই স্থানীয়।
পর্যটক কমার কারণ জানতে চাইলে নগরীর জিন্দাবাজারের হোটেল গোল্ডেন সিটির মহাব্যবস্থাপক মৃদুল কান্তি দত্ত মিষ্টু বলেন, ‘বন্যা চলে গেছে। কিন্তু বাইরের জেলার অনেকের ধারণা সিলেট এখনো ডুবে আছে। বন্যা, রাস্তাঘাট ভাঙা, সিলেট এসে কোথায় ঘুরব এমন ধারণা থেকে তারা এবার সিলেট আসেনি। ’
সিলেট হোটেল গেস্ট হাউস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও গার্ডেন ইন হোটেলের স্বত্বাধিকারী নওশাদ আহমদ চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পর্যটক একেবারেই নেই। সবার অবস্থা খুব খারাপ। ’ এমন পরিস্থিতির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বন্যা ও দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা। বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও মানুষের কাছে ভুল বার্তা রয়ে গেছে হয়তো—এখনো সিলেট ডুবে আছে। ’
পর্যটকশূন্য মৌলভীবাজার
বর্ষায় সেজেছে মৌলভীবাজারের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্র। কিন্তু বাইরের জেলার পর্যটকদের দেখা নেই। অভিজাত হোটেলসহ শতাধিক হোটেল, রিসোর্ট ও কটেজের বেশির ভাগই ফাঁকা।
ঢাকার রামপুরার বাসিন্দা ইয়ারুন নেছা বলেন, ‘ইচ্ছা ছিল শ্রীমঙ্গলে রাতে থেকে সিলেটের লালাখাল ও জাফলং ঘুরে দেখব। কিন্তু বন্যার কারণে এসব এলাকায় যাওয়া যাচ্ছে না। এখন শুধু শ্রীমঙ্গল ঘুরতে হচ্ছে। ’ একই কথা জানালেন চট্টগ্রামের তাপস পাল ও রফিকুল ইসলাম।
সিলেটে বন্যা শেষ হয়ে গেলেও এর প্রভাবে শ্রীমঙ্গলে পর্যটকের দেখা নেই বলে জানালেন মৌলভীবাজার জেলার সিনিয়র ট্যুর গাইড সৈয়দ রিজভী ও সোলেমান হাসিব। তাঁরা বলেন, ‘প্রতিটি হোটেল ও রিসোর্টের মাত্র চার-পাঁচটি কক্ষে পর্যটক রয়েছে। দূরের কোনো পর্যটক বা বিদেশি পর্যটকের আগমন ঘটেনি। যার ফলে আমরা অলস সময় পার করছি। ’
মৌলভীবাজার পর্যটন সেবা সংস্থার কোষাধ্যক্ষ ও বালিশিরা রিসোর্টের চেয়ারম্যান শহীদুল হক বলেন, ‘আশানুরূপ বুকিং হয়নি। পর্যটকরা মনে করছেন সিলেটের বন্যা মানেই শ্রীমঙ্গল। ’
টাঙ্গুয়ার হাওরে পর্যটক নেই বললেই চলে
ঈদেও সুনামগঞ্জের টাঙ্গুয়াসহ হাওরাঞ্চলে পর্যটকদের ভিড় নেই। এ কারণে পর্যটকবাহী নৌকা, স্পিডবোট ও পর্যটনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ ব্যবসায়ীর হাতে কোনো কাজ নেই। পর্যটকবাহী নৌযান ব্যবসায়ী শাহ আলম বলেন, ‘ঈদে জেলার বাইরে থেকে তেমন কোনো পর্যটক হাওরে ঘুরতে আসেনি। তাই আমাদের ব্যবসা নেই বললেই চলে। ’
তাহিরপুর সদর লামাবাজারের মুদি ব্যবসায়ী ইয়াসির আরাফাত বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা এখন পর্যটকনির্ভর। বন্যায় দোকানের মালামাল নষ্ট হয়েছে। ভেবেছিলাম ঈদে ব্যবসা করে ক্ষতি কিছুটা হলেও পুষিয়ে নেব। কিন্তু পর্যটক না থাকায় ব্যবসা নেই। ’
কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকের ভিড় বাড়ছে
ঈদুল আজহার প্রথম দুই দিন কক্সবাজার সৈকতে পর্যটকদের তেমন ভিড় ছিল না। গতকালই ভিড় দেখা গেছে। তবে অন্যান্য বছরের তুলনায় কম।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ও গেস্ট হাউস মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সেলিম নেওয়াজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সোমবার রাতেও আমাদের সমিতিভুক্ত হোটেলগুলোতে তেমন অতিথি ছিল না। কিন্তু গতকাল সকাল থেকেই একের পর এক কক্ষ ভাড়া হতে থাকে। ’
দক্ষিণে পর্যটন চাঙ্গা
গত ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরের দিন থেকে এটি সাধারণ মানুষের যাতায়াতের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। সেদিন থেকে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনীতিতে নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়, ভিড় বাড়তে থাকে সেখানকার পর্যটনকেন্দ্রগুলোতে।
পদ্মা সেতু দেখতে পর্যটকদের ভিড়
ঈদের ছুটিতে পদ্মা সেতু দেখতে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার পদ্মার পারে দর্শনার্থীদের ঢল নামে। উৎসব মুখর পরিবেশের সৃষ্টি হয় পদ্মার তীরজুড়ে। পর্যটকরা সেতু দেখার পাশাপাশি ইলিশ খেতে ছুটে যায় শিমুলিয়া ঘাটের রেস্তোরাঁগুলোতে।
গাজীপুরের মাহমুদ হাসান জানান, তাঁরা পাঁচ বন্ধু মিলে গাজীপুর থেকে পদ্মা সেতু দেখতে এসেছেন। এই সেতু দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়।
কুমিল্লার দাউদকান্দির আল আমিন শেখ বলেন, এখানে না এলে বুঝতে পারতাম না পদ্মা সেতু কত মজবুত ও সুন্দর করে বানানো হয়েছে।
দেশি-বিদেশি পর্যটকে মুখর কুয়াকাটা
গত সোমবার থেকে সাগরকন্যা কুয়াকাটায় রেকর্ডসংখ্যক পর্যটকের আগমন ঘটেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানের পর্যটকের পাশাপাশি রাশিয়া, চীনসহ বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা ছুটে এসেছেন ১৮ কিলোমিটারের দৈর্ঘ্যের সমুদ্রসৈকতে।
ঢাকা থেকে আসা মো. শাওন আকন বলেন, ‘আমাদের পরিবারের ১০ জন সদস্য দুই দিন আগে কুয়াকাটায় এসেছি। এখন কুয়াকাটা আমাদের খুব কাছের এবং আকর্ষণীয় সমুদ্রসৈকত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ’
কুয়াকাটা হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মোতালেব শরীফ কালের কণ্ঠকে বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পরপরই পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। কুয়াকাটায় দেড় শতাধিক ছোট-বড় আবাসিক হোটেল-মোটেল রয়েছে। সব হোটেল সিটসংখ্যা বাড়িয়েছে। প্রতিদিন এসব হোটেলে ১৫ থেকে ২০ হাজার পর্যটক থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। একই সঙ্গে স্থানীয় বহু বাসা-বাড়ি পর্যটকদের কাছে ভাড়া দেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে।
চট্টগ্রামের বিনোদনকেন্দ্রে উপচে পড়া ভিড়
ঈদের ছুটি শেষ হলেও নগরবাসীর ঈদ বিনোদন এখনো শেষ হয়নি। গতকাল থেকে অফিসপাড়া সচল হয়ে উঠলেও নগরীর বিনোদনকেন্দ্রগুলো দর্শনার্থীদের কোলাহলে মুখর ছিল। ঈদের প্রথম দিন পশু কোরবানির ব্যস্ততা কাটিয়ে সোমবার ঈদের দ্বিতীয় দিন থেকে মূলত নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত, কাজীর দেউড়ি শিশুপার্ক, ফয়স লেক অ্যামিউজমেন্ট পার্ক, বহদ্দারহাটের স্বাধীনতা পার্ক, কর্ণফুলী শিশু পার্ক, সিআরবি শিরীষতলা বিনোদন পিপাসুদের পদচারণে মুখর হয়ে ওঠে। পাশাপাশি নগরীর ফয়স লেক এলাকায় অবস্থিত চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানাও নগরবাসীর বিনোদনের অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে।
দুই শিশু সন্তান নিয়ে চিড়িয়াখানায় আসা রিয়াদুল ইসলাম বলেন, ‘ছুটি কম থাকায় এবার গ্রামের বাড়ি যশোর যাওয়া সম্ভব হয়নি। এ কারণে সবার মন খারাপ। বাচ্চাদের আনন্দ দিতে তাই ঘুরতে বেড়িয়েছি। ’
ভোলার বিনোদনকেন্দ্রগুলোতে পর্যটকের ঢল
ভোলা সদরের তুলাতলী বিনোদনকেন্দ্র, তুলাতুলি ইলিশ বাড়ি, বঙ্গবন্ধু উদ্যান, জেলা পরিষদ চত্বর, বাঘমারা ব্রিজ, ভেলুমিয়া কায়াকিং পয়েন্ট, ইলিশা মেঘনা রিসোর্ট, লালমোহনের সজীব ওয়াজেদ জয় ডিজিটাল পার্ক, চরফ্যাশনে জ্যাকব টাওয়ার, শেখ রাসেল শিশু ও বিনোদন পার্ক, ফ্যাশন স্কয়ার, বেতুয়া প্রশান্তি পার্ক, খামারবাড়ি, কুকরী-মুকরী পর্যটনকেন্দ্রে দর্শনার্থীদের ঢল নেমেছে।
এ ছাড়া মনপুরা দখিনা হাওয়া সি-বিচ, হাকিমুদ্দি ও মঙ্গলসিকদার লঞ্চঘাট, ইলিশা ফেরিঘাটসহ বেশ কিছু দর্শনীয় স্থানে মানুষের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো।
লোকে-লোকারণ্য ষাটগম্বুজ মসজিদ
বাগেরহাটে বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ ঐতিহাসিক ষাটগম্বুজ মসজিদ এলাকা ছিল লোকে-লোকারণ্য। ঢাকার কলেজ শিক্ষক আসলাম শেখ ও চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মনিরুল ইসলাম জানান, পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় তাঁরা পরিবার নিয়ে ষাটগম্বুজ মসজিদ দেখতে এসেছেন। সেতু চালু না হলে তাঁদের আসা হতো না।
এ ছাড়া বাগেরহাটের যাত্রাপুরের কোদলায় অযোধ্যা মঠ, বারাকপুরে সুন্দরবন রিসোর্ট, দশানী শিশু পার্ক, নাগেরবাজার পৌর পার্ক, চুলকাঠি চন্দ্রমহলসহ বিভিন্ন পার্ক ও বিনোদনকেন্দ্রগুলো দর্শনার্থীরা ঘুরে দেখেছে।
এ জাতীয় আরো খবর..