আইপিএলের রাজস্থান রয়্যালস, সানরাইজার্স হায়দরাবাদ, দিল্লি ক্যাপিটালস ও মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স; পিসিএলের লাহোর কালান্দার্স এবং ন্যাটওয়েস্ট টি–টোয়েন্টি ব্লাস্টের সাসেক্স—সাকিব আল হাসানের পর বিদেশের টি–টোয়েন্টি লিগ খেলার দিক দিয়ে বাংলাদেশে মোস্তাফিজুর রহমানের ‘সিভি’টাই সবচেয়ে ভারী।
কিন্তু এই যে মোস্তাফিজের এত ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার অভিজ্ঞতা, সেটা বাংলাদেশের ক্রিকেটের কতটা কাজে আসছে? কাজে আসা বলতে শুধু বল হাতে তাঁর নিজের পারফরম্যান্সের কথাই বলা হচ্ছে না, বাঁহাতি এই পেসার বিদেশি লিগে খেলার, বিদেশি ক্রিকেটারদের একই ড্রেসিংরুমে দেখার এবং টি–টোয়েন্টির ‘পাওয়ার হিটার’দের বোলিং করার অভিজ্ঞতা কতটা বিনিময় করছেন জাতীয় দলের ড্রেসিংরুমে? বাংলাদেশ দল যে টি–টোয়েন্টিতে এখনো মাঝেমধ্যেই শূন্য থেকে শুরু করার জায়গায় চলে যায়, সেটারই–বা কী কারণ? মোস্তাফিজই বলুন—বাংলাদেশ কেন টি–টোয়েন্টিতে ভালো খেলে না?
গায়ানায় বাংলাদেশ দলের ঠিকানা ম্যারিয়ট হোটেলের লবিতে গতকাল মোস্তাফিজের সামনে রাখা হয়েছিল প্রশ্নটা। মোস্তাফিজ অল্প কথার মানুষ, আনুষ্ঠানিক কথাবার্তায় তো গুটিয়ে যান আরও। তাই বলে এমন নয় যে তাঁর মস্তিষ্কে ক্রিকেটের বিশ্লেষণ নেই। বরং বৃষ্টির দিনের দুপুরে তিনি বেশ বুঝিয়েই কথাটার উত্তর দিলেন।
‘আমাদের মূল সমস্যা মানসিকতায়। অন্য দলের ব্যাটসম্যানরা দেখবেন ৭–৮টা বলে রান না পেলেও আবার ঠিকই ফিরে আসে, আক্রমণ করে। বোলারদের কথা যদি বলেন, দু–একটা বল খারাপ করেও অন্য দেশের বোলাররা দ্রুত ফিরে আসে। আমার মনে হয় আমরা এই জায়গাতে পিছিয়ে। আমরা দ্রুত ভেঙে পড়ি এবং দ্রুত খারাপ অবস্থা থেকে ফিরতে পারি না’—ম্যারিয়টে দলের বোলারদের নিয়ে কোচদের এক সভার পর প্রথম আলোকে কথাগুলো বলছিলেন মোস্তাফিজ।
সুযোগ পেলে তিনি নাকি সতীর্থদেরও বলেন, টি–টোয়েন্টিতে গতি ধরতে পারাটাই আসল এবং সেটা চিন্তার ক্ষেত্রেও, ‘যখন যাকে দরকার হয় আমি বলি কী করা উচিত বা কী উচিত নয়। আমি যতটুকু বুঝি ওদেরও তা বোঝাই।’
টি–টোয়েন্টি আসলেই গতির খেলা। ব্যাটিং, বোলিং, ফিল্ডিং হতে হবে গতিময়। দ্রুততা থাকতে হবে চিন্তাভাবনাতেও। টি–টোয়েন্টির অনেক কৌশল তো বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের এখনো শেখার আছেই, সামর্থ্যও বাড়ানোর আছে অনেক জায়গায়। কিন্তু মোস্তাফিজ যে জায়গাটিতে টোকা দিয়ে গেলেন, সেটিই বোধ হয় সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ—টি–টোয়েন্টির মানসিক গঠন।
মোস্তাফিজের ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে খেলার অভিজ্ঞতা বাংলাদেশ দলের স্কোরকার্ডে কতটা প্রভাব ফেলছে, সেটিও আলোচনায় আসতে পারে। সাকিব আইপিএল–সিপিএল ইত্যাদি খেলে জাতীয় দলের জন্য কী বয়ে আনতে পারছেন, তা তো তাঁর পারফরম্যান্সেই উজ্জ্বল। মাঝে কয়েক ম্যাচে ভালো না খেললেও ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে প্রথম দুই টি–টোয়েন্টিতে ব্যাট হাতে তিনিই ছিলেন সেরা। মোস্তাফিজের বাঁহাতি পেস বোলিং থেকে অভিজ্ঞতার সেই আলোটা কি পাচ্ছে বাংলাদেশ দল?
একেবারে পাচ্ছে না, তা বলা যাবে না। গত টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বোলিং ভালো না হলেও এরপর পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের বিপক্ষে হোম সিরিজে মোস্তাফিজ ছিলেন নিয়ন্ত্রিত। নিজে খুব বেশি উইকেট হয়তো পাননি, কিন্তু তাঁর ইকোনমি রেটের কৃপণতার সুবিধা পেয়েছেন অন্য প্রান্তের বোলিং–সঙ্গীরা।
এই যে কখনো ভালো বোলিং কখনো খারাপ, মোস্তাফিজের কাছে এর ব্যাখ্যাটা খুব সরল, ‘এশিয়ার উইকেট এক রকম, এশিয়ার বাইরের উইকেট আরেক রকম। এশিয়ার বাইরে উইকেট বেশি ভালো থাকে। এশিয়ার মধ্যে দেখবেন টি–টোয়েন্টিতে ১৫০ রান করতেই কষ্ট হয়। আর এশিয়ার বাইরে দুই শ রানও নিরাপদ নয়। আমার ইকোনমি রেট বাড়ার এটা একটা কারণ হতে পারে।’
তবে নিজের বোলিংয়ের ওপর যথেষ্টই আস্থা তাঁর। যাঁরা বলেন, মোস্তাফিজের বোলিং থেকে আগের ধারটা হারিয়ে গেছে, তাঁদের সঙ্গেও পুরোপুরি একমত নন তিনি। তবে হ্যাঁ, আরও ভালো কীভাবে করা যায়, সেই চেষ্টা নাকি চালিয়ে যাচ্ছেন নিরন্তর, ‘অস্ত্রোপচার করানোর পর হয়তো এক–দেড় বছর আমার পারফরম্যান্স ভালো ছিল না। এরপর তো...তবে শেখার শেষ নেই। প্রতিদিনই শেখা যায়। আমিও চেষ্টা করছি আরও উন্নতি করতে...বিশ্বের অন্য ভালো বোলারদের মতো কীভাবে হওয়া যায়। ফিটনেসে উন্নতি আনা বলেন, কোচদের পরামর্শ নেওয়া বলেন—সবভাবেই শিখছি।’
জাতীয় দলের পেস বোলিং কোচ অ্যালান ডোনাল্ডের সঙ্গে কাজ করার এখনো খুব বেশি সময় পাননি। তবে দক্ষিণ আফ্রিকান কিংবদন্তির পরিকল্পনা ও পরামর্শ বেশ পছন্দই হচ্ছে মোস্তাফিজের, ‘সাদা বলে আমি মাত্র দুটি সেশন করেছি (ডোনাল্ডের সঙ্গে), বিশেষ করে টি–টোয়েন্টি নিয়ে। আর ওয়ানডের জন্য কাজ করেছি দক্ষিণ আফ্রিকায়। খুব বেশি দিন এখনো ওনাকে পাইনি। তবে কোচের পরিকল্পনাগুলো খুব ভালো লাগছে।’
মোস্তাফিজের চেষ্টাটা এখন বেশি এশিয়ার বাইরে কীভাবে আরও ভালো বোলিং করা যায় তা নিয়েই। তবে এটি দীর্ঘমেয়াদি লক্ষ্য, গায়ানায় আপাতত মোস্তাফিজসহ পুরো বাংলাদেশ দলেরই চাওয়া প্রোভিডেন্স স্টেডিয়ামে আগামীকালের শেষ টি–টোয়েন্টিটা জিতে সিরিজ ড্র করা।
সে জন্যই করণীয় বুঝিয়ে দিতে গতকাল টিম হোটেলে বোলারদের নিয়ে বসেছিলেন কোচিং স্টাফের সদস্যরা। সেখানে কী আলোচনা হয়েছে, জানতে চাইলে এক বাক্যে মোস্তাফিজের উত্তর, ‘আমরা কীভাবে আরও ভালো বোলিং করতে পারি, সেটা নিয়ে কথা বলেছি।’
এক বাক্য হলেও এটিতেই বলা আছে সব কথা—টি–টোয়েন্টিতে ভালো করার সূত্র। ‘আরও ভালো’ খেলার বিকল্প তো আসলেই কিছু নেই।
এ জাতীয় আরো খবর..