রাজধানীতে বুটিক হাউসের আড়ালে সোনা চোরাচালান করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। শাহরুখ চৌধুরী নামে এক ব্যবসায়ী দম্পতির বিরুদ্ধে এ অভিযোগ। রাজধানীর পিংক সিটিতে 'লিনাস থাউজেন্ড থিংস' নামের একটি বুটিক হাউস রয়েছে তাদের। যেটি শাহরুখ চৌধুরীর নামে পরিচালিত হয়।
এই বুটিক হাউসের আড়ালেই অনেক দিন ধরে দুবাই থেকে সোনা চোরাচালান করার অভিযোগ রয়েছে এই দম্পতির বিরুদ্ধে।
পোশাক কেনার নামে কোটি কোটি টাকা পাচারের অভিযোগও রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থা এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। তবে তাদের অনুসন্ধান শুরু হওয়ার পরপরই তারা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে। বিভিন্ন সংস্থা তাদেরকে খুঁজছে বলেও জানিয়েছে একাধিক সূত্র।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী জানায়, একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাবেক কর্মকর্তার স্ত্রী এই শাহরুখ চৌধুরী। গুলশান এলাকায় থাকার সুবাদে রাজধানীর পিংক সিটিতে লিনাস থাউজেন্ড থিংস নামে একটি বুটিক শপ খুলে বসেন। মূলত অনলাইনকেন্দ্রিক ছিল শপটি।
লিনাস থাউজেন্ডসের ফেসবুক পেজ এত দিন চললেও এখন সেটি বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। যার প্রায় সবগুলো পোশাকই পাকিস্তানি এবং ইন্ডিয়ান। তবে এই পোশাকগুলো কিনতে তারা একাধিকবার দুবাই যেতেন সপরিবারে। বিভিন্ন অবৈধ চ্যানেলে শুল্ক ফাঁকির মাধ্যমে এগুলো দেশে আনার অভিযোগ রয়েছে।
সূত্র জানায়, গত ৬ ফেব্রুয়ারি দুবাই থেকে ফেরার পথে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণ, বিদেশি মদ এবং ১০ লাখ টাকা মূল্যের ওমেগা ব্র্যান্ডের ঘড়িসহ ইমিগ্রেশনে আটক হন শাহরুখ চৌধুরীর স্বামী সৈয়দ ওয়াসিকুল হক। পরে বিভিন্ন মহলের সুপারিশে জরিমানা এবং মুচলেকা দিয়ে আপাতত মুক্তি মিললেও বিষয়টি নিয়ে তৎপরতা চালায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।
জানা যায়, তার স্বামী সৈয়দ ওয়াসিকুল হককে ছেড়ে দেওয়া হলেও তার পাসপোর্ট এবং সাথে থাকা ক্রেডিট কার্ড অনুসন্ধান করে অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। শাহরুখ চৌধুরী সংযুক্ত আরব আমিরাতের পি আর পাসপোর্টের (নং ২৬৭৩৪৮০৮) অধিকারী। পাসপোর্ট পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঘন ঘন সংযুক্ত আরব আমিরাত যাতায়াত করেন তিনি। প্রতিবারই সেখান থেকে বিপুল পরিমাণ স্বর্ণসহ মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে ঢাকায় ফেরেন। যা এত দিন গোয়েন্দাদের চোখ ফাঁকি দিলেও আটকের পর বিষয়টি নিয়ে সরব হয় সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।
আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, শাহরুখ চৌধুরী ওরফে লীনা বুটিক ব্যবসার আড়ালে দুবাই থেকে স্বর্ণালংকার এবং মূল্যবান জিনিসপত্র অবৈধভাবে বাংলাদেশে আনেন। এই কাজ তিনি ২০১৮ সাল থেকে করে আসছেন। মূলত হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠানো হয় দুবাইয়ে। তারপর নামেমাত্র সেখান থেকে কিছু বুটিক পণ্য আনলেও বেশির ভাগই বিনিয়োগ করেন সংযুক্ত আরব আমিরাতে। সেখানে গুড লুকস রেডিমেড গার্মেন্টস ট্রেডিং নামের একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেরও সন্ধান পান গোয়েন্দারা। শাহরুখ চৌধুরী ও তার পরিবারের সদস্যরা এর সঙ্গে জড়িত বলে জানা গেছে।
শাহরুখ চৌধুরীর ক্রেডিট কার্ড ও জাতীয় পরিচয়পত্রের মাধ্যমে তার বেশ কিছু ব্যাংক হিসাবেরও তথ্য পাওয়া গেছে। বেরিয়ে এসেছে অস্বাভাবিক লেনদেনের চিত্র। সেখানে দেখা যায়, গত ২২ ডিসেম্বর সংযুক্ত আরব আমিরাতে একসঙ্গে ৩৪ লাখ টাকার সোনা কেনেন শাহরুখ চৌধুরীর স্বামী। বিল পরিশোধ করা হয় ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ সোনা কেনায় তার ভিসা কার্ডে নগদ দুই হাজার ৯৭৭ সেন্ট ট্যাক্স রিফান্ড যোগ হয়। এ ছাড়া ৩১ ডিসেম্বর শেখ ডেরা সিটি সেন্টারের রিভলি এন্টারপ্রাইজ নামের একটি দোকান থেকে ৩৪ হাজার ৮৫০ দিরহাম দিয়ে কেনেন লিমিটেড এডিশনের একটি দামি ওমেগা ঘড়ি। বাংলাদেশি টাকায় যার মূল্য ১০ লাখ।
আটকের পর যাচাই-বাছাইয়ের জন্য স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির খোঁজে মাঠে নামেন গোয়েন্দারা। তাদের ৫০ কোটিরও বেশি সম্পদের প্রমাণ মেলে। তার উল্লেখযোগ্য সম্পদের মধ্যে রয়েছে মিরপুর ডিওএইচের ২ নম্বর রোডের ১৬ নম্বর এভিনিউ রোডের ডুপ্লেক্স একটি ফ্ল্যাট, (যার বাজারমূল্য ছয় কোটিরও বেশি), বনশ্রীতে ফ্ল্যাট এবং নামে-বেনামে অনেক সম্পত্তির হিসাব মেলে। বিদেশেও রয়েছে বড় বড় বিনিয়োগ। সংযুক্ত আরব আমিরাতে আজমাইন এলাকায় গুডলাক নামের একটি দোকানও রয়েছে তার। বিনিয়োগের সুবাদেই দুবাইয়ে স্থায়ী বসবাসের অনুমতি পান তারা। জহিরুল ইসলাম খন্দকার নামে শাহরুখ চৌধুরীর স্বামী ওয়াশিকুল হকের বন্ধুর মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ পাচার করে এই ব্যবসা গড়ে তোলেন।
সূত্র জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন শপিং মলে একাধিক দোকানের পজিশন ভাড়া রয়েছে তার। এর মধ্যে গুলশানের পিংক সিটিতে একটি, পুলিশ প্লাজায় একটি, ধানমণ্ডির অরচার্ড প্লাজায় তিনটি দোকানের সন্ধান পাওয়া গেছে। এর মধ্যে পিংক সিটিতে 'লিনাস থ্যাউজেন্ড থিংস' অনলাইন বুটিক শপটির মাধ্যমে তিনি ব্যবসা পরিচালনা করতেন। রাতারাতি বিদেশ পালিয়ে যাওয়ার পর পিংক সিটির দোকানটি নাম পরিবর্তন করে নতুন নামে ব্যবসা পরিচালনা শুরু করে। এটি আসলে তার দোকানের ম্যানেজার মিথুন রায়ের নামে হস্থান্তর করে দেন। এখন দোকানের নতুন নাম ইন্ডিয়ান ক্রিয়েশন, যা দোকানের ম্যানেজার মিথুন রায় নিজের নামে পরিচালনা করছেন।
সূত্র জানায়, মদ ও স্বর্ণসহ আটকের পর গোয়েন্দা নজরদারিতে পড়ে শাহারুখ দম্পতি। তাদের বিরুদ্ধে শুরু হয় নানামুখী অনুসন্ধান। রাতারিতিই স্বামীকে তার চাকরি ছাড়িয়ে নিয়ে চলে যান আত্মগোপনে। বড় বিপদ আঁচ করতে পেরে একপর্যায়ে দেশ ছাড়েন তারা।
ইমিগ্রেশন সূত্র জানায়, চোরাকারবারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগে শাহারুখ চৌধুরী এবং তার স্বামীর পাসপোর্ট নম্বর ব্লক করা হয়। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি জানতে পেরে বিদেশি পাসপোর্টে ইমিগ্রেশন পার হন তারা। দেশ ছাড়ার আগে একসঙ্গে ৭৬ ভরি স্বর্ণ বিক্রি করেন তারা। দোকানের ম্যানেজার মিথুন রায় এবং পারিবারিক কেয়ারটেকার খলিলের সহযোগিতায় এই স্বর্ণ বিক্রি করেন। শাহরুখ চৌধুরী দম্পতি অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বার্বুডার পাসপোর্টে ইমিগ্রেশন পার হয়েছেন বলেও নিশ্চিত হওয়া গেছে।
শাহরুখ চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাজধানীর পল্লবী থানার মামলায় একটি গ্রেপ্তারি পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে। প্রতারণার এবং অর্থপাচার আইনে আরো কিছু মামলার প্রস্তুতি চলছে। শাহরুখ চৌধুরী বিনিয়োগ সংগ্রহের নাম করে বিভিন্নজনের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করতেন এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়া-আসা করতেন।
পল্লবী থানার ওসির পারভেজ ইসলাম বলেন, 'শাহরুখ চৌধুরীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। তার পল্লবীর বাড়িতে গিয়ে তাকে পাওয়া যায়নি। গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। '
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পল্লবী থানার এক কর্মকর্তা জানান, এই দম্পতির বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ। বুটিক ব্যবসার আড়ালে অবৈধ কারবারের অভিযোগ আমলে নিয়ে অনুসন্ধান চলছে।
এ জাতীয় আরো খবর..