দুই বছরের ধারাবাহিক ইসরায়েলি হামলায় গাজার অর্থনীতি সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী, ক্ষতির পরিমাণ ৬ হাজার ৮শ কোটি ডলার—যা আধুনিক ইতিহাসে নজিরবিহীন।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর গাজার অর্থনীতি ৮৩ শতাংশ সংকুচিত হয়েছে, দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে গেছে প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ। ধ্বংস হয়েছে ৯০ শতাংশ অবকাঠামো ও ২ লাখ ৯২ হাজার ঘরবাড়ি। শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোরও ৯০ শতাংশ নিশ্চিহ্ন।
ফিলিস্তিনের মোট জিডিপি কমেছে ৮৬ শতাংশ, পশ্চিম তীরেও ২৩ শতাংশ সংকোচন ঘটেছে। বেকারত্ব গাজায় পৌঁছেছে ৮০ শতাংশে; সাত লাখ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন।
বেসরকারি খাতে উৎপাদন ক্ষতি ২৫০ কোটি ডলার, ধ্বংস হয়েছে ৮২ শতাংশ প্রতিষ্ঠান। সরবরাহব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় খাদ্যের দাম বেড়েছে ৪৪০ শতাংশ পর্যন্ত।
জাতিসংঘ, ইইউ ও বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, গাজা পুনর্গঠনে অন্তত ৫ হাজার ৩০০ কোটি ডলার প্রয়োজন। প্রতিটি ঘরে ধ্বংস, অনিশ্চয়তা ও দারিদ্র্যের ছাপ—গাজার মানুষ এখন শুধু টিকে থাকার সংগ্রামে।
গাজা উত্তরণ পরবর্তী পরিস্থিতিতে নেতৃত্বমূলক ভূমিকা নিতে চাইছে সৌদি আরব। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই-এর হাতে আসা সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক গোপন প্রতিবেদনে এই পরিকল্পনার কথা উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, সৌদি আরব হামাসকে নিরস্ত্র ও প্রভাবশীন করে ফেলে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে (প্যালেস্টাইনিয়ান অথরিটি — পিএ) আর্থিক ও লজিস্টিক সহায়তা দিয়ে শক্তিশালী করার পরিকল্পনা করছে। দলিলটি তারিখিত ২৯ সেপ্টেম্বর।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, রাজত্বটি গাজার জন্য একটি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের উদ্যোগকে সমর্থন করবে এবং এতে সৌদি আরবসহ অন্যান্য আরব ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ অংশ নিতে পারে। দলিলটিতে এতে গাজার স্থিতিশীলতা বৃদ্ধির সৌদি দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করা হয়েছে এবং হামাসের ভূমিকা ধাপে ধাপে প্রান্তিক করার কৌশল বর্ণনা করা হয়েছে।
দলিলটিতে বলা হয়েছে, হামাসকে নিরস্ত্র করার প্রক্রিয়া হবে ধাপে ধাপে এবং তা আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক চুক্তির মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে—যাতে নিরপেক্ষতা বজায় থাকে। পাশাপাশি গাজায় প্রশাসনিক দায়িত্ব ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের হাতে হস্তান্তর করলে হামাসের প্রভাব কমে যাবে বলে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়াকে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের (two-state solution) সঙ্গে সংযুক্ত করতেও দলিলটি উল্লেখ করেছে।
সৌদি পরিকল্পনায় ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে দুর্নীতি মোকাবিলা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও সর্বস্তরের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার করা হবে। এছাড়া পিএ’কে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা প্রদানের কথাও বলা থাকলেও কত পরিমাণ অর্থ দেয়া হবে তা প্রতিবেদনে উল্লেখ নেই। পরিকল্পনার বাস্তবায়নে মিসর, জর্ডান ও প্যালেস্টাইনিয়ান কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পরামর্শের ওপর জোর দিতেও বলা হয়েছে। রিপোর্টে প্রক্রিয়াটির নির্দেশনা দিয়েছেন সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা মানাল বিনতে হাসান রাদওয়ান—এমন তথ্য রয়েছে দলিলে।
প্রতিবেদনে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটও তুলে ধরা হয়েছে—ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ২০০৭ সালের পরে গাজায় উপস্থিতি বজায় রাখতে পারেনি; সেই সময় ফাতাহ ও হামাসের মধ্যে সংঘাতের পর পিএ’র নিয়ন্ত্রণ সীমাবদ্ধ হয়ে আসে। সৌদি দলিলটি মনে করে, গাজায় কার্যকর প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে একই সঙ্গে দুই রাষ্ট্রভিত্তিক লক্ষ্যের দিকে অগ্রসর হওয়া যেতে পারে।
কূটনৈতিক প্রেক্ষাপট হিসেবে দলিলটি উল্লেখ করেছে, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের বক্তব্য ও সৌদি-ফ্রান্স যৌথ প্রস্তাবনার পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে। তবে কিছু দেশে বিতর্ক ও অনুপস্থিতিও লক্ষ্য করা গেছে—যার মধ্যে শারম আল-শেইখ শীর্ষ বৈঠকে সৌদি যুবরাজ ও আমিরাতি নেতাদের অনুপস্থিতির ইঙ্গিতও এসেছে।
সামগ্রিকভাবে সৌদি আরবের এই পরিকল্পনা গাজা-পরবর্তী পুনর্গঠন, নিরাপত্তা ও প্রশাসন বিন্যাসে আঞ্চলিক ভূমিকা পালনে একটি বৃহৎ কূটনৈতিক ও নীতিগত প্রয়াস হিসেবে দেখা হচ্ছে। পরিকল্পনাটি বাস্তবে কিভাবে রূপ পাবে এবং মিসর, জর্ডান, প্যালেস্টাইন ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সমন্বয় কেমন হবে—এসবই এখন বিতর্ক ও নজরদারির বিষয়।