×
  • প্রকাশিত : ২০২২-০৮-১৬
  • ৫৭ বার পঠিত
পুরান ঢাকার চকবাজারের কারখানা ও গুদামের সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ বসবাসের কারণে আরেকটি দুর্ঘটনায় ঝরল ছয়জনের প্রাণ। গতকাল সোমবার দুপুরে চকবাজারের কামালবাগ দেবীদ্বারঘাটে একটি ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর সেখান থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

মৃতরা হলো বিল্লাল সরদার (৩৫), আব্দুল ওয়াহাব ওসমান (২৫), স্বপন সরকার (২২), রুবেল (৩২), মোতালেব (১৫) ও শরিফ (১৫)। তারা সবাই ভবনটির নিচতলায় ‘বরিশাল হোটেল’ নামের একটি রেস্তোরাঁর কর্মী।

ছয়জনই ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে ঘুমিয়ে ছিল বলে ধারণা করছেন উদ্ধারকারীরা। নিচতলার রেস্তোরাঁ ও প্লাস্টিকের গুদাম থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ভবনটির তৃতীয় তলা এবং টিনশেড দিয়ে তৈরি করা চতুর্থ তলায় প্লাস্টিকের কারখানা ও গুদাম ছিল।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলছেন, সরু রাস্তার গলিতে আবাসিক ভবনে কারখানা ও গুদাম ঝুঁকিপূর্ণভাবে থাকায় এই প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে। একই এলাকায় আরো অনেক ভবন ঝুঁকিপূর্ণ।

উদ্ধারকারীরা জানিয়েছেন, গতকাল দুপুর ১২টার দিকে লাগা আগুন ১০টি ইউনিটের চেষ্টায় বেলা আড়াইটার দিকে নিয়ন্ত্রণে আসে। এর মধ্যে কারখানার ভবনটির লাগোয়া আরো তিনটি ভবনের কিছু অংশ আগুনে পুড়েছে। উদ্ধার করা মৃতদেহগুলো বেশি দগ্ধ ও খণ্ডিত হওয়ায় শনাক্ত করা যাচ্ছে না। ময়নাতদন্ত ও ডিএনএ পরীক্ষার নমুনা সংগ্রহের জন্য মৃতদেহগুলো স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে।

সন্ধ্যায় ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা সদরের জোন-১-এর উপসহকারী পরিচালক বজলুর রশিদ বলেন, ‘নিহত ছয়জনের মধ্যে পাঁচজনের মরদেহ আগুনে পুড়ে হাড় বেরিয়ে গেছে। একজনের চেহারা কিছুটা বোঝা যায়। প্রাথমিকভাবে আমাদের ধারণা, তারা ঘুমন্ত অবস্থায় ছিল। ’ সন্ধ্যা পর্যন্ত আগুনের ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ ও তল্লাশি চলছিল বলে জানান ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক।

পুলিশের লালবাগ বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) জাফর হোসেন বলেন, উদ্ধার করা মরদেহগুলো স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষায় পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর মরদেহগুলো পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

‘পুরো এলাকা ঝুঁকিপূর্ণ’

আগুন নিয়ন্ত্রণের পর দুপুর আড়াইটার দিকে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান বলেন, ভবনের নিচতলার সামনের দিকে ছিল রেস্টুরেন্ট আর পেছনের দিকে ছিল প্লাস্টিকের গুদাম। দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় ছিল প্লাস্টিকের ও জুতার সোলের গোডাউন। এ ছাড়া ভবনের চতুর্থ তলার একদিকে ছিল প্লাস্টিকের খেলনা তৈরির সরঞ্জামের কারখানা ও গুদাম।

জিল্লুর রহমান বলেন, ‘পুরান ঢাকায় অনেক প্লাস্টিকের কারখানা আছে। এগুলো সব অনিরাপদ। কোনো ভবনেই অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা নেই। ভবনগুলো অনেক নাজুক। আসার পর দেখছি পুরো এলাকায় এমন কারখানা ও গুদাম আছে। এলাকাটি ঝুঁকিপূর্ণ। ’ তিনি আরো বলেন, ‘এর আগেও এই পুরান ঢাকায় অনেক প্লাস্টিকের কারখানা ও গোডাউনে আগুনের ঘটনা ঘটেছে। যতবার আগুন লেগেছে ততবারই হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ’

আগুনের সূত্রপাতের বিষয়ে জানতে চাইলে জিল্লুর রহমান বলেন, অধিদপ্তর থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। তদন্ত সাপেক্ষে আগুনের সূত্রপাত ও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে। কেমিক্যাল পাওয়া গেছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা এখন পর্যন্ত প্লাস্টিকের খেলনা, জুতার সোল, পলিথিন থাকতে দেখেছি। কোনো কেমিক্যাল পাওয়া যায়নি। ’

রাশিদুল হাসান, আব্দুল বারেক ও ওমর ফারুক নামের তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী জানান, নিচতলার বরিশাল হোটেলের ভেতরে প্রথমে বিস্ফোরণ ঘটে এবং আগুন দেখা যায়। এরপর ভবনের সামনের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার বিস্ফোরিত হয়। এরপর পেছনের কারখানা ও ওপরের অংশে দাউদাউ করে আগুন জ্বলে ওঠে। ভবনটির পাশের তিনটি ভবনও আগুনে কিছুটা পুড়েছে। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা কয়েকটি দিক থেকে পানি ছিটিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণ করেছেন। এর আগেই ভবনটির নিচতলা থেকে চতুর্থ তলা পর্যন্ত পুড়ে গেছে।

স্থানীয় লোকজন জানায়, ভবনটির মালিক চকবাজারের আলম নামের এক ব্যক্তি। ভবনটি দেখাশোনা করতেন ব্যবস্থাপক আলাউদ্দিন। গুদাম ও কারখানার মালিক নজরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। আর বরিশাল হোটেলের মালিকের নাম ফকরুদ্দিন। তাঁর বাড়ি বরিশালে। অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে তাঁদের কাউকে দুর্ঘটনাস্থলে দেখা যায়নি।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, বাইরে থেকে সিঁড়ি দিয়ে দোতলার একটি অংশে উঠতে হয়। তৃতীয় তলার ওপরে টিন দিয়ে চতুর্থ তলা পর্যন্ত ভবনটিকে বাড়ানো হয়েছে। গলির ভেতরের সরু পথ দিয়ে বিভিন্ন অংশে যেতে হয়।

স্বজনরা কেঁদে দেখিয়ে দিল লাশ

দুর্ঘটনাস্থলে দেখা গেছে, মৃত্যুর আশঙ্কা করা হলেও আগুন নেভানোর পরে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কোনো মৃতদেহ পাওয়া যায়নি। ততক্ষণে নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজনরা দুর্ঘটনাস্থলে এসে আহাজারি শুরু করে। বিকেল পৌনে ৪টার দিকে আবদুল্লাহ নামের এক ব্যক্তি দাবি করেন, তাঁর ভগ্নিপতি বিল্লাল রেস্টুরেন্টের কর্মী। বিল্লাল রাতে কাজ শেষে দোতলায় ঘুমাতেন। তিনি আগুনে আটকা পড়েছেন। আবদুল্লাহকে সঙ্গে নিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা গলির ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঁকি দিয়ে দেখেন, বরিশাল হোটেলের ওপরের অংশের একটি কক্ষ পুড়ে গেছে। সেখানে মৃতদেহ দেখে আবদুল্লাহ ‘আমার ভাই, আমার ভাই’ বলে বিলাপ শুরু করেন। পরে সেখানে তল্লাশি করে একে একে ছয়জনের লাশ উদ্ধার করেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। এ সময় ভিড় করা স্বজনরা কান্নায় ভেঙে পড়ে।

নিখোঁজ ওসমানের খালাতো ভাই রুবেল দুর্ঘটনাস্থলে এসে বলেন, ওসমানসহ আটজন রাতে কাজ করে ভবনের দোতলায় ঘুমিয়ে ছিল। তাদের দু-একজন নিচে নেমেছে। একাধিকবার ওসমানের ফোনে কল করলেও সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় ১২৪ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চকবাজারের চুড়িহাট্টায় আরেকটি অগ্নিকাণ্ডে নিহত হয় ৭৪ জন। এ ছাড়া প্রায়ই পুরান ঢাকায় রাসায়নিকের গুদাম, কারখানা ও ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। প্রতিবারই পুরান ঢাকা থেকে কারখানা ও গুদাম সরানোসহ ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলা হলেও অনেক উদ্যোগই বাস্তবায়ন করা হয়নি।

নিউজটি শেয়ার করুন

এ জাতীয় আরো খবর..
ফেসবুকে আমরা...
ক্যালেন্ডার...

Sun
Mon
Tue
Wed
Thu
Fri
Sat