মহানবী (সা.)-কে নিয়ে বিজেপি মুখপাত্রের মন্তব্যের প্রতিবাদে সোচ্চার আরব দেশগুলি। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের নিন্দা।শুরু করেছিল ওমান। তারপর কাতার, কুয়েত, ইরান ও সৌদি আরবও সোচ্চার হয়। বিজেপি মুখপাত্র নূপুর শর্মা সম্প্রতি মহানবী (সা.)-কে নিয়ে যে বিতর্কিত মন্তব্য করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায় এই দেশগুলি। রোববার কুয়েত ও কাতার ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠায়। কাতার জানিয়েছে, তারা বিজেপি মুখপাত্রের বিতর্কিত মন্তব্যকে খারিজ করছে এবং তীব্র নিন্দা করছে।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ মোহাম্মদ আল আনসারি বলেছেন, কাতার চায়, ভারত সরকার অবিলম্বে ওই মন্তব্যের নিন্দা করুক এবং সারা বিশ্বের মুসলিমদের কাছে ক্ষমা চাক। কাতারের প্রতিক্রিয়া ছিল যথেষ্ট কড়া। ভারতের উপ রাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু এখন কাতার সফর করছেন। সেই কথা মাথায় রাখলে সফর চলাকালীন কাতার কঠোর অবস্থান নিয়ে ভারত সরকারকে ক্ষমা চাইতে বলেছে। কুয়েতও ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠিয়েছিল। তারা রাষ্ট্রদূতের হাতে প্রতিবাদ-নোট তুলে দেয়। সেখানে বলা হয়েছে, কুয়েত বিজেপি মুখপাত্রের মন্তব্য খারিজ করছে এবং নিন্দা করছে। কুয়েতও ভারত সরকারকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে বলেছে। ইরানও ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে ডেকে পাঠায়।
তারা রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছে, বিজেপি মুখপাত্ররা মহানবী (সা.)-কে অপমান করেছে। এটা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আগামী সপ্তাহে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভারত সফর করার কথা। তার আগে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে এই বিতর্কে ইরান রীতিমতো ক্ষুব্ধ। সৌদি আরবের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, বিজেপি মুখপাত্ররা মহানবী (সা.)-কে অপমান করেছেন। প্রতিটি ধর্ম ও বিশ্বাসকে শ্রদ্ধা করা উচিত। আরো প্রতিক্রিয়া অর্গানাইজেশন অফ ইসলাম কোঅপারেশন বিজেপি মুখপাত্রদের বিবৃতির কড়া নিন্দা করে বলেছে, মহানবী(সা:)-কে অপমান করা মেনে নেয়া যায় না।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরীফ বিবৃতি দিয়ে বলেছেন, মহানবী (সা.)-র বিরুদ্ধে বিজেপি নেতারা যা বলেছেন, তার তীব্র নিন্দা করছি। মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতে ধর্মীয় স্বাধীনতাকে নষ্ট করা হচ্ছে। তিনি বলেছেন, মহানবী(সা.)-র জন্য সব মুসলিম তার জীবন দিয়ে দিতে পারে। আফগানিস্তানও এর তীব্র নিন্দা করেছে। বিজেপি-র সিদ্ধান্ত বিজেপি তাদের মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে সাসপেন্ড করেছে এবং নবীন কুমার জিন্দলকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলের তরফ থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে,বিজেপি সব ধর্মকে সম্মান করে। কোনো ধর্মীয় ব্যক্তিত্বকে অপমান করা বিজেপি মেনে নেয় না। কোনো ধর্ম বা পন্থা, মতাদর্শকে অপমান করা বিজেপি মেনে নেয় না। এরকম কোনো ব্যক্তি বা দর্শনকে বিজেপি উৎসাহ দেয় না। ভারতীয় সংবিধান অনুসারে সব নাগরিক তার ধর্ম পালন করতে পারেন। প্রতিটি ধর্মকে শ্রদ্ধা করতে হয়।
সরকারের বক্তব্য এখনো পর্যন্ত ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র অরিন্দম বাগচী ওআইসি-র বিবৃতির প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন। তিনি বলেছেন,ভারত সরকার ওআইসি-র অযাচিত ও সংকীর্ণ মানসিকতার বিবৃতি খারিজ করছে। ভারত সরকার সব ধর্মকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা জানায়। কিছু ব্যক্তি ধর্মীয় ব্যক্তিত্বদের সম্পর্কে আপত্তিকর টুইট ও মন্তব্য করেছে। এটা কোনোভাবে ভারত সরকারের মত নয়। সংশ্লিষ্ট সংগঠন ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিয়েছে। ওআইসি সচিবালয় আবার উদ্দেশ্যমূলকভাবে মন্তব্য করেছে। এটা মেনে নেয়া যায় না। এটা তাদের বিভাজনের কর্মসূচিকেই সামনে আনছে। আমরা তাদের কাছে আবেদন জানাই, এরকম সাম্প্রদায়িক মন্তব্য তারা যেন না করে। পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগের জবাবে অরিন্দম বাগচী আরেকটি টুইট করে বলেছেন, যে দেশে সংখ্যালঘু অধিকার বলে কিছু নেই, সেখানকার প্রধানমন্ত্রী অযোক্তিক, অর্থহীন অভিযোগ করেছেন। কাতার ও ইরানে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতরা জানিয়েছেন, একেবারেই ছোটখাট স্তরের কিছু নেতা এইসব কথা বলেছে। এটা কখনই ভারত সরকারের মত হতে পারে না। বিজেপি ওই মুখপাত্রদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। সৌদি আরব ও বাহরিন ভারতের এই অবস্থানকে স্বাগত জানিয়েছে।
ভারতে প্রতিক্রিয়া কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ বলেছেন, কাতার প্রতিবাদ করার পর বিজেপি তাদের দুই মুখপাত্রকে বরখাস্ত করেছে। অ্যামেরিকানরা এটাকেই বলেন, গুজ কপ-ব্যাড কপ রুটিন। প্রথমে নিজেদের কর্মীদের আপত্তিকর মন্তব্য করতে দাও। তারপর চাপের মুখে ব্যবস্থা নাও, যাতে মনে হয় তারা মধ্যপন্থা নিয়ে চলছে। এআইএমআইএম নেতা আসাদুদ্দিন ওয়েইসির দাবি, ক্ষমা চাওয়া যথেষ্ট নয়, নূপুর শর্মাকে গ্রেপ্তার করতে হবে। কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর একটি পোস্ট ট্যাগ করে টুইট করেছেন। সেখানে বলা হয়েছে, কীভাবে সৌদি আরব ও বাহরিনে ভারতীয় জিনিস সুপারমার্কেট থেকে সরিয়ে ফেলা হচ্ছে। চাপে কতটা ফল হবে? আরব দেশগুলি মহানবী (সা.) বিতর্ক নিয়ে ভারতের উপর চাপ সৃষ্টি করতে চেয়েছে। সেই চাপ কতটা কার্যকর হবে? প্রবীণ সাংবাদিক ও ইসলাম-গবেষক মিলন দত্ত মনে করেন, এই চাপে খুব বেশি কাজ হবে না।
ডয়চে ভেলেকে মিলন বলেছেন, বিজেপি-র পক্ষে নিজেকে পাল্টানো সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক চাপের ফলে দুজনকে বরখাস্ত করেছে বিজেপি। এটা না করে তাদের উপায় ছিল না। কিন্তু এর মানে এই নয় যে, বিজেপি বদলে যাবে।
মিলন বলেছেন, আরএসএস প্রধান বলেছেন, সব মসজিদে গিয়ে শিবলিঙ্গ খোঁজার দরকার নেই। এরপর কি শিবলিঙ্গ খোঁজা বন্ধ হবে? জ্ঞানবাপীতে আর কেউ শিবলিঙ্গ খুঁজবেন না। এমনটা মনে হয় না। এখন যে জায়গায় পরিস্থিতি চলে গেছে, বিজেপি-ও তার কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। তারা তো তাদের বিশ্বাস থেকে কথা বলছে। তাই নিজেদের বদলানো তাদের পক্ষে কঠিন।
আরেক প্রবীণ সাংবাদিক জয়ন্ত ভট্টাচার্য়ও বলেছেন, বিজেপি তার দুই মুখপাত্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। কিন্তু এরপর ফলে কি বিতর্ক থেমে যাবে? মনে হয় না। এই চাপ খুব বেশি কার্যকর হবে না।
আর্থিক দিক থেকে গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল বা জিসিসি-র সঙ্গে ভারত ২০২০-২১ সালে আট হাজার ৭০০ কোটি টাকার বাণিজ্য করেছে। জিসিসি-র মধ্যে কাতার, বাহরিন, সৌদি আরব, ওমান ও আমিরাত আছে। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে প্রচুর ভারতীয় চাকরি করেন। তারাও প্রচুর অর্থ দেশে পাঠান। নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর অনেকবার মপ্রাচ্যের দেশগুলিতে সফর করেছেন। অশোধিত তেল নিয়ে ভারত এই দেশগুলির উপর নির্ভরশীল। কিছু সাবেক কূটনীতিকের মতে, এই বিতর্কে ভারত অসুবিধাজনক জায়গায় আছে। এখন নেতৃত্ব যদি গুরুত্ব দিয়ে চেষ্টা করে, তাহলেই আরব দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্ক আবার ঠিক হবে।
এ জাতীয় আরো খবর..