ভোজ্যতেল নিয়ে এখনও কারসাজি চলছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যটির দাম কমলেও সেই অনুপাতে দেশের বাজারে কমছে না। বিশ্ববাজার অনুযায়ী দেশে সয়াবিন ১২৪ টাকা লিটার হওয়ার কথা। কিন্তু সরকার দাম বেঁধে দিয়েছে ১৮৫ টাকা। বাস্তবে এ দামেও বাজারে সয়াবিন তেল পাওয়া যাচ্ছে না।
এছাড়া নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি আমদানিতে ভ্যাট ছাড়, এলসি কমিশন ও এলসি মার্জিন প্রত্যাহারের সুফলও ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছায়নি। ব্যবসায়ীরা এককভাবে এ সুবিধা নিয়ে মুনাফা করেছেন। এপ্রিলে এসব সুবিধা নিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি আমদানি করেছেন বড় মিল মালিক ও আমদানিকারকরা। এতে দাম পড়ছে কম। কিন্তু বাজারে বিক্রি করছেন বেশি দামেই। বর্তমানে ডলারের দাম বৃদ্ধি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ নানা কারণে সংকট চলছে। এর মধ্যেও এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী তেল নিয়ে ফায়দা লুটেই চলেছে।
বিশ্ববাজার পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত বছর সয়াবিন তেলের বার্ষিক গড় দাম আগের বছরের তুলনায় ৬৫ শতাংশ বেড়েছিল। প্রতি টনের মূল্য ৮৩৮ থেকে ১৩৮৫ ডলারে উন্নীত হয়। আর মার্চে ১৯৬৫ ডলার পর্যন্ত ওঠে। এপ্রিলে দাম বেড়ে ২১০০ ডলারের উঠেছিল। যদিও জুনের শেষদিকে দাম কমতে শুরু করে। চলতি জুলাইয়ে দামের ব্যাপক দরপতন হয়েছে। বিশ্ববাজারে বর্তমানে ১৩২০ থেকে ১৩৫০ ডলারে লেনদেন হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়ার রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, লকডাউন, ভারতসহ বড় ভোক্তা দেশগুলোর চাহিদা হ্রাস, তেল উৎপাদন বৃদ্ধি, রপ্তানিকারক দেশগুলোয় মজুত বেড়ে যাওয়ায় বাজারে এমন দরপতন হচ্ছে। কিন্তু দেশের বাজারে তেলের দাম সে অর্থে কমছে না।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম দুই মাসের ব্যবধানে কমেছে ৩২ শতাংশ। বর্তমান দর অনুসারে লিটারপ্রতি সয়াবিনের দাম ১২৪ টাকা এবং পাম অয়েলের দাম ৭১ টাকা। অথচ দেশের বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম এখন লিটারপ্রতি ১৯৫ এবং খোলা পাম ১৫৫ টাকা। জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রের কমোডিটি এক্সচেঞ্জ শিকাগো বোর্ড অব ট্রেডে মে মাসের প্রথম সপ্তাহে পরিশোধিত সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে হয়েছিল টনপ্রতি ১৯৫০ ডলার। বৃহস্পতিবার এ দর নেমে আসে টনপ্রতি ১৩১৮ ডলারে। অর্থাৎ দেশের ডলার রেট বিবেচনায় লিটারপ্রতি দাম ১২৪ টাকা। দুই মাসে দরপতন হয়েছে ৬৩২ ডলার বা ৩২ শতাংশ। যা ভোজ্যতেলের ইতিহাসে সর্বোচ্চ দরপতন।
জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, যখন বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম বাড়তি ছিল তখন পণ্যটি আমদানিতে সরকারের পক্ষ থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার ছাড়াও বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আর ওই সুবিধা নিয়ে আমদানি করা তেল দেশের বাজারে এলে দাম কমার কথা ছিল। কিন্তু বাস্তবে দাম কমলেও সে অনুপাতে কমানো হয়নি। তাই ক্রেতারা এর সুফল পুরোপুরি পাচ্ছেন না।
বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, বিশ্ববাজারে দাম কমেছে সেটা সত্য। সে অনুপাতে দেশের বাজারেও কমানো হচ্ছে। কিন্তু যে হারে কমছে সে হারে কমানো সম্ভব হচ্ছে না। কারণ দেশে ডলারের দাম বেড়ে গেছে। এ ছাড়া এই দামের সঙ্গে জাহাজ ভাড়াসহ আনুষঙ্গিক খরচ যুক্ত হয়। পাশাপাশি বন্দর দিয়ে এখন যেসব তেল আমদানি হচ্ছে, তার ঋণপত্র বিশ্ববাজারে চড়া দাম থাকার সময় খোলা হয়েছে, যা এখন বাজারের সরবরাহ করা হচ্ছে। কিন্তু গত কিছু দিন ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে বড় দরপতন হচ্ছে। সেসব তেল দেশে আসতে দেড় মাস সময় লাগবে। হয়তো তখন দাম সমন্বয় করে বিক্রি হবে।
এদিকে বিশ্ববাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমায় সরকার ১৭ জুলাই বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম লিটারপ্রতি ১৪ টাকা কমিয়ে ১৮৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। আর ২ লিটারের বোতলের সয়াবিন তেলের দাম ৩৯৮ টাকা থেকে কমিয়ে করা হয় ৩৭০ টাকা এবং ৫ লিটারের বোতল ৯৮০ টাকা থেকে কমিয়ে আনা হয় ৯১০ টাকায়। সরকার নির্ধারিত এ দাম ১৮ জুলাই থেকেই কার্যকর হওয়ার কথা ছিল। তবে এর তিন দিন পর নির্ধারিত দামে সয়াবিন তেল বিক্রির ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ ভেজিটেবল অয়েল রিফাইনার্স অ্যান্ড বনস্পতি ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশন। সংগঠনটির ঘোষণা অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) থেকেই বাজারে নতুন দামের তেল পাওয়ার কথা। তবে শুক্রবার সরেজমিন রাজধানীর বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দোকানে সরকার নির্ধারিত দামে সয়াবিন তেল মিলছে না। এক লিটার বোতলের সয়াবিন তেল ১৯৫ টাকা এবং পাঁচ লিটারের বোতল ৯৫০ থেকে ৯৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ক্যাব ভাইস প্রেসিডেন্ট নাজের হোসাইন বলেন, সরকার তেলের দাম বাড়ালে সঙ্গে সঙ্গে বিক্রেতারা বাড়তি দর কার্যকর করে বিক্রি করে। আর সরকার দাম কমালে সঙ্গে সঙ্গে কমায় না। বিক্রেতারা নানা অজুহাত দিয়ে বাড়তি দরেই বিক্রি করে। এ সময়ও বিক্রেতারা বাড়তি মুনাফা লুটে নেয়। যা বন্ধ করতে হবে।
এ জাতীয় আরো খবর..