আশঙ্কাজনক হারে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধিই রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোর প্রধান সমস্যা। যে কারণে ব্যাংকের মূলধন পর্যাপ্ত হারে সংরক্ষণ সম্ভব হচ্ছে না। এর নেতিবাচক প্রভাবে দুর্বল হয়ে পড়ছে আর্থিক ভিত্তি। এছাড়া শ্রেণিকৃত ও অবলোপন করা ঋণ থেকে আদায় কম এবং গুণগত ঋণের শ্লথগতিও অন্যতম বড় সমস্যা হিসাবে শনাক্ত করা হয়েছে।
সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বার্ষিক কর্মসম্পাদন চুক্তিপত্রে এসব সমস্যার তথ্য তুলে ধরেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো। এসব সমস্যা মোকাবিলা করে চলতি অর্থবছরে (২০২২-২৩) মোট খেলাপি ঋণ থেকে ২ হাজার ২শ কোটি টাকা আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা মনে করেন, বাংলাদেশে ঋণখেলাপি একটি স্থায়ী সংস্কৃতিতে পরিণত হয়েছে। এর কারণ, খেলাপিদের আইনের আওতায় না আনা এবং ক্ষমতাসীন রাজনীতির সঙ্গে তাদের যোগাযোগ। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ এম কে মুজেরী যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ দীর্ঘদিনের সমস্যা। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এটি সঠিকভাবে মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়নি। বিভিন্ন সময়ে ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করা হয়েছে। যে কারণে অনেকেই এই সংজ্ঞা পরিবর্তনের কারণে অন্যায্য সুবিধা নিয়েছে। এখন খেলাপি ঋণ কমিয়ে আনতে সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এর মোকাবিলা করতে হবে। না হলে এটি কোনোভাবেই কমিয়ে আনা সম্ভব নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে গত মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণের অঙ্ক দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ২৬ হাজার ৩৮৯ কোটি টাকা। শুধু ৩ মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) বেড়েছে ১০ হাজার ১৬৭ কোটি টাকা। আর বিগত এক বছরে বেড়েছে খেলাপি ঋণ ১৮ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা।
অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে অর্থ আদায়ের যে প্রতিশ্রুতি ব্যাংকগুলো দিয়েছে, বিষয়টি ভালো। কিন্তু ব্যাংকগুলোর ঋণ আদায়ে দায়িত্বরত কর্মকর্তারা সঠিকভাবে পালন করছে কি না, তা ‘ব্যাংক টু ব্যাংক’ ধরে মনিটরিং করতে হবে। এক্ষেত্রে খেলাপি ঋণ আদায়ে ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের পরিচালকদের ভালো ও দক্ষ কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দিতে হবে। আর যদি এক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়, অবশ্যই ওই কর্মকর্তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিতে হবে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো প্রতি অর্থবছরের কর্মকাণ্ডের একটি পরিকল্পনা বা রূপরেখা তৈরি করে। পরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সঙ্গে কর্মসম্পাদন নামে প্রতিটি ব্যাংক চুক্তি করে। মূলত ব্যাংকগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনতে এ ধরনের চুক্তি সম্পাদন করা হয়। নতুন অর্থবছরের রূপরেখায় ব্যাংকগুলো তাদের প্রধান সমস্যাগুলো তুলে ধরে। পাশাপাশি খেলাপি এবং অবলোপন ঋণ থেকে কত টাকা আদায় করবে, মোট খেলাপি ঋণের অঙ্ক, লোকসানি শাখা কমিয়ে আনাসহ নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে।
কর্মসম্পাদন চুক্তিপত্রে প্রতিটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকই বলেছে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ব্যাসেল-৩-এর সঙ্গে সংগতি রেখে মূলধন সংরক্ষণ পর্যাপ্তভাবে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) ঘাটতি বেড়েই চলছে। ফলে শ্রেণিকৃত ঋণের আধিক্যই বর্তমানে প্রধান সমস্যা। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকের মুনাফা অর্জনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
সেখানে আরও বলা হয়, ঋণখেলাপিরা টাকা পরিশোধ করতে অনীহা দেখাচ্ছে। টাকা না দিয়ে উলটো মন্দ গ্রাহকরা আদালতে রিট করে দিচ্ছে। এসব রিট নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতায় পড়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। পাশাপাশি রিট নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘সিআইবি ইস্টে’ থাকার কারণে ঋণ আদায় কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর মূলধন পর্যাপ্ত হারে সংরক্ষণ ও শ্রেণিকৃত ঋণ আদায় এক ধরনের চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
জানা যায়, উচ্চ আদালতের নির্দেশনার (স্থগিতাদেশ) কারণে ২১ হাজার ৪৬ কোটি টাকা আদায় সম্ভব হচ্ছে না বলে সম্প্রতি বাজেট অধিবেশনে জাতীয় সংসদে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল।
বহুল আলোচিত বেসিক ব্যাংকের চুক্তিপত্রে উল্লেখ করা হয়, ‘২০১০-১৪ সালে ব্যাংকটিতে সংঘটিত অনিয়মের ফলে শ্রেণিকৃত ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬৭ দশমিক ৯২ শতাংশ। শ্রেণিকৃত ঋণ বৃদ্ধি পাওয়ায় মূলধন এবং প্রভিশন ঘাটতি বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে মুনফা অর্জনেও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। সেখানে আরও বলা হয়, শ্রেণিকৃত ঋণের আধিক্য বর্তমান ব্যাংকের প্রধান সমস্যা এবং এটি হ্রাস করাই প্রধান চ্যালেঞ্জ।
শীর্ষ পর্যায়ে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর চুক্তিপত্রে অন্যান্য সমস্যার মধ্যে রয়েছে প্রযুক্তি ব্যবহারে সীমাবদ্ধতা, গুণগত ঋণ বৃদ্ধিতে শ্লথগতি, শ্রেণিকৃত ঋণ থেকে আদায় কম ও বেসরকারি ব্যাংকের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতা। এছড়া মামলা নিষ্পত্তিতে ধীরগতি, সুদ আয় হ্রাস, রিট ভ্যাকেটে দীর্ঘসূত্রতার কারণে ঋণ আদায় কার্যক্রমে বাধাগ্রস্তকে সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করা হয়।
এদিকে চলতি অর্থবছরে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলো ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে প্রায় ২ হাজার ২শ কোটি টাকা আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংক খেলাপি ঋণ আদায়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ৫০০ কোটি টাকার। এ বছর শ্রেণিকৃত ঋণের অঙ্ক ১১ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনবে। প্রতিশ্রুতিতে জনতা ব্যাংক চলতি অর্থবছরে ৩০০ কোটি টাকার শ্রেণিকৃত ঋণ আদায়ের পাশাপাশি মোট ১২ হাজার কোটি টাকার মধ্যে এ ঋণের অঙ্ক রাখা হবে। এছাড়া অবলোপনকৃত ঋণ থেকে আদায় করবে ৪০ কোটি টাকা।
এছাড়া ৪০০ কোটি টাকার শ্রেণিকৃত এবং ৫০ কোটি টাকা অবলোপন ঋণ আদায়ের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে অগ্রণী ব্যাংক। একই সময়ে এ ব্যাংক বছর শেষে ৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনবে শ্রেণিকৃত ঋণ এমনটি বলেছে। একইভাবে রূপালী ব্যাংক আদায় করবে ১৫০ কোটি টাকা শ্রেণিকৃত এবং ১০ কোটি টাকা অবলোপনকৃত ঋণ আদায়ের ঘোষণা দিয়েছে। আর বছর শেষে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকায় নামিয়ে আনা হবে খেলাপি ঋণের অঙ্ক।
এদিকে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক শ্রেণিকৃত ঋণ আদায়ের ক্ষেত্রে বলছে ক্রমান্বয়ে এটি করা হবে। তবে বছর শেষে এ ব্যাংক তাদের খেলাপি ঋণের অঙ্ক ৪ হাজার ১০০ কোটি টাকা নিয়ে আসবে। রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ৩০০ কোটি টাকা, বহুল আলোচিত বেসিক ব্যাংক ১০০ কোটি টাকা খেলাপি ঋণ এবং ৫০ কোটি টাকা অবলোপ ঋণ আদায়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) আদায় করবে ৪০ কোটি টাকা, আনসার ভিডিবি ব্যাংক ৫০ কোটি, কর্মসংস্থান ব্যাংক ১২ কোটি এবং প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক ১০ কোটি টাকা।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, সব পর্যায়ে শুদ্ধাচার নীতি পরিপালনসহ ব্যাংকের সামগ্রিক কার্যক্রমে সুশাসন প্রতিশ্রুতি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এ বিভাগ কাজ করছে। তবে কোভিড-১৯-এর কারণে অনেক প্রতিষ্ঠানের ঋণ ও অগ্রিম থেকে সুদ আয় কমেছে। পাশাপাশি পুঁজিবাজার, ফি ও কমিশন থেকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর আয় কমেছে। স্বল্প সুদে জামানত সংগ্রহ করছে ব্যাংকগুলো। এসব সমস্যার পাশাপাশি সঞ্চয়কারীদের অর্থ এবং প্রাতিষ্ঠানিক তহবিল উত্তোলনের কারণে অনেক ব্যাংক সমস্যায় পড়েছে। এসব বিষয় তুলে ধরেছে ওই চুক্তিপত্রে।
এ জাতীয় আরো খবর..